টেকনাফের বুকে কুদুমের কোলে

আহমাদ যুবায়ের


২৪শে মার্চ ২০১৬ অনেক প্রতীক্ষার পর সময় আর সুযোগ দুটোই পেয়ে গেলাম ট্রাভেলিংয়ের জন্য। সহকর্মী সাঈফুদ্দীন ভাই, ছোট ভাই মামুন,মুনির, বন্ধু ওয়াকার, আতিক আর ফারুক মিলে সাত জনের একটি টিম। লক্ষ্য হোয়াইক্যং হয়ে টেকনাফ। প্রচন্ড গরমের সময় ছিলো তখন।চট্টগ্রাম থেকে রাত একটার গাড়িতে উঠে গেলাম সবাই। বলাবাহুল্য টেকনাফ আমার গ্রামের বাড়ী হওয়া সত্ত্বেও গ্রামের বাড়ি হ্নীলা নামটি ছাড়া তখন অব্দি কিছুই জানতাম না। যাই হোক, পরদিন জুমাবার ভোর ছয়টার কিছু পরে আমাদেরকে নামিয়ে দেওয়া হলো হোয়াইক্যং বাজারে। অপরিচিত জায়গা, তবে গ্রামের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। বেইজ ক্যাম্প হিসেবে বেছে নিলাম হোইয়ক্যং জামে মসজিদকে, সুন্দর পরিবেশ আর ছোট পুকুর ঘাট।মসজিদের ইমামের সাথে কথা বলে লাগেজ গুলো দ্বিতীয় তলায় রাখার ব্যবস্থা করে বেরিয়ে পড়লাম সকালের নাস্তার জন্য। নাস্তা সেরে হোয়াইক্যং বাজার থেকে টমটম ঠিক করলাম আমাদের প্রথম স্পট বাংলাদেশে প্রাপ্ত তখন অব্দি একমাত্র সর্ববৃহৎ বালুর গুহা "কুদুম গুহা'
কুদুম গুহা/ফটোঃ সাঈফুদ্দীন ভাই


স্থানীয়রা অনেকে ডাকাত আর অজগর সাপের ভয় দেখালেও সাহস সঞ্চয় করে যাত্রা শুরু করে দিলাম। হাতে সেফটির জন্য ধারাল ছুড়ি,টর্চ, মোমবাতি আর মুখে তসবীহ। হোয়াইক্যং বাজার হয়ে টমটম হরিখোলা গ্রাম স্কুল পেড়িয়ে থামলো, ডাকাতের আশঙ্খা দূর করার জন্য স্থানীয় এক আদিবাসী (চাকমা) গাইড হিসেবে নিয়ে নিলো সাঈফুদ্দীন ভাই। আমরা যাচ্ছি গাইডের পিছুপিছু।প্রায় ঘন্টা দেড়েক ট্রাকিংয়ের পর পৌছুলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য ''কুদুম গুহার'' সামনে।
কুদুমে যাওয়ার রাস্তা/ফটোঃসাঈ্ফুদ্দীন ভাই
বাহির থেকে মনে হচ্ছিলো বিশাল এক দানব হা করে আছে গিলে খাওয়ার জন্য! বিসমিল্লাহ বলে নেমে পড়লাম পরষ্পরের হাত ধরে একে একে। বিশাল এক গুহা যতোই সামনে যাচ্ছি গুহার পানির উচ্চতা যেনো ততোই বাড়ছে।কারো বুক অব্দি কারোবা গলা অব্দি পানি উঠে আসলো যখন আমরা গুহার একেবারে মাঝামাঝি স্থানে।অজগরের ভয়ও ছিলো সাথে। ভয়ে ভয়ে এগুচ্ছিলাম হঠাৎ মাথার উপর দিয়ে একঝাক বাদুর উড়ে গেলো চিঁচিঁ আওয়াজ তুলে আর তাদের শুকনো মল আমাদের গায়ে। আৎকে উঠলাম কয়েক মুহুর্তের জন্য।পায়ে সাথে কিলবিল করছিলো অসংখ্য বিষাক্ত ছোট ছোট মাছ।একবার বলে ফেললাম চলো ফিরে যায়, কিন্তু সাইফুদ্দীন ভাই বললেন এসেই যখন পড়েছি শেষ দেখে যাবো। সাহস পেলাম সবাই। শেষ প্রান্তে এসে পৌছুলাম যেনো বিশ্ব জয়ের আনন্দ পেলাম। হাতে মোম্বাতি ছিলো জ্বালিয়ে দিলাম, পুরো গুহা আলোকিত হয়ে গেলো, যদিও সেটা আমাদের ভুলই ছিলো, বাদুরের মল থেকে সৃষ্ট গ্যাস যদি জমা থাকতো ভিতরে তাহলে যে কোন দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। যাই হোক, আমরা পারলাম কুদুম জয় করে আসতে। বেড়িয়ে গাইডকে বিদায় করে দিলাম।এবার কি? কোন প্ল্যান ছিলো না পূর্ব নির্ধারিত। গাইডের ভাষ্যমতে হরিখোলা গ্রামের লম্বা সরু পিচ ঢালা রাস্তার শেষ- বাংলাদেশ সীমানার শেষ। আমি বলাম, বাংলাদেশের দক্ষিণে তো পুরোটাই সাগর, তাহলে নিশ্চয় সাগর থাকবে, শেষ হবে কেনো! সবাই একমত, ঠিক হলো রাস্তা দিয়ে সোজা হাটা দিয়ে এর শেষ কোথায় সেটাই এক্সপ্লোর করবো।ফ্ল্যাট ট্রাক তাই সবাই রাজি।আমি তো একপায়ে রাজিই। প্রায় ঘন্টা দেড়েক হাটার পরও যখন রাস্তা শেষ হচ্ছিলো না তখনই গাড়ির আওয়াজ আসলো কানে, একটা জীপ আসতে দেখলাম আমরা পেছন থেকে, থামিয়ে কেউ ছাদে কেউ ভিতরে চেপে বসলাম।গাড়ি এসে থামলো শাপলাপুর বাজারে, যদিও গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছিলো শ্যামলাপুর! বাজার পার হতেই আমাদের চক্ষু চড়কগাছ!সেকি বিশাল বিশাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে আছড়ে পড়ছিলো সৈকতে, এককথায় অকল্পনীয়। অর্ধচন্দ্ররুপ বিশাল মাছ ধরার নৌকা সারি করে রাখা আর জেলেদের হৈ হৈ করে সমুদ্রের বুকে নৌকা বাসানো, জাল থেকে মাছ ছাড়ানো এই প্রথম দেখছিলাম স্বচক্ষে।
শাপলাপুর সমুদ্র সৈকত

সমুদ্রস্নান শেষে আমাদের বেইস ক্যাম্প হোয়াইক্যং জামে মসজিদের পথ ধরলাম।জুমার নামাজ পড়ে টেকনাফের বাসে চড়ে বসলাম ট্রাভেলিংয়ের দ্বিতীয় পর্ব টেকনাফ রিজার্ভ ফরেস্টের উদ্দেশ্যে। স্থানীয় আর এক বিজিবি সদস্য থেকে রিজার্ভ ফরেস্ট ব্যাপারে অনুসন্ধানের পরও যখন কোন কুল পাচ্ছিলাম না, রাতটা হ্নীলা গ্রামেই কাটাবো বলে ঠিক হলো। মূলত টেকনাফ পুরো বনাঞ্চলটাকেই রিজার্ভ ফরস্ট হিসেবে সরকারী নতিভুক্ত, কোন নির্দিষ্ট স্থান রিজার্ভ ফরেস্ট বলে নেই। রাতটা শিকদার কটেজে কাটিয়ে দিলাম।
পরদিন সকাল সকাল নাস্তা সেরে বেড়িয়ে পরলাম তৈঙ্গা পাহাড়ের খোজে। টমটম নিয়ে হ্নীলা বাজার হতে নয়াপাড়া কালভার্টের উপর এসে টমটম থামালাম।এখান থেকেই মূলত আমাদের ট্রাকিং শুরু।
নয়াপাড়াায় তৈঙ্গার খোজে

ছোট ছোট দুটো স্থানীয় ছেলেকে আমাদের গাইড হিসেবে নিয়ে নিলাম। বিল পেড়িয়ে আমরা পাহাড়ের পিঠে যাত্রা শুরু করলাম। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিলো ঘোড়া আর কুইজ্জা পাহাড়ের শীর্ষ।পাড়ি দিতে হবে অনেক দূর, গন্তব্য নেই জানা। ট্রেকিংয়ের সময় বুঝছিলাম টেকনাফের পাহাড় গুলো বান্দরবনের পাহাড় থেকে অনেক রুক্ষ আর শুষ্ক
ঘোড়া পাহাড়ের পাদদেশে
যার কারণের আমাদের সবারই প্রচন্ড রকম ঘাম ঝরছিল সীমার অতিরিক্ত।প্রায় ঘন্টা তিনেক ট্রেকের পর কুইজ্জা পাহাড়ের উপর এসে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! পাহাড়ের শীর্ষ থেকে সুবিশাল সমুদ্র দেখা যাচ্ছিলো।
কুইজ্জা পাহাড়ের পিঠে
এই ট্যুরে অন্ততঃপক্ষে আমি ফারুককে উপরে ছবিতে আমার পিছনে ধন্যবাদ না দিয়ে থাকতে পাড়ি না, কেননা ঘোড়া পাহাড়ের জলাধারে পড়ে গিয়ে আমার আত্মবিশ্বাস এতো কমে গিয়েছিলো যে আমি আর এগুতেই পাড়ছিলাম না। এই ছেলেই তখন আমার সাথে পা মিলে চলছিলো। বিশেষ ধন্যবাদ তাঁকে।
কুইজ্জা পাহাড়ের পীঠে ওয়াকা্র ও তার পেছনে আতিক

কুইজ্জা পাহাড়ের খাদ

আমরা লক্ষ্য স্থীর করে নিলাম- পাহাড় পাড়ি দিয়ে সমুদ্রে পৌছুতে হবে। কুইজ্জা সহ ছোট বড় মিলিয়ে পচিশটি পাহাড় ডিঙ্গীয়ে গ্রামে নেমে আসলাম।
গ্রামবাসীদের সাথে বাম থেকে ফারুক,আমি, সাইফুদ্দীন ভাই আর আতিক

গ্রামের লোকজন আমাদের ট্রেকিংয়ের কথা শুনে বিস্মিত।এটা ছিলো মেরিন ড্রাইভ রোড থেকে ঘন্টার হাটা সৈকতের(বালুর) রাস্তা, সবে মাত্র কাজ শেষ হচ্ছিলো, যান চলাচল নেই, কোলাহল নেই, উপায়ান্তর না পেয়ে এই পথ আমাদের হেটেই পাড় করা লাগলো।

জনমানবহীন সৈকতে আমাদের টিম 


মজার ব্যাপার হলো মাঝে মাঝে চলতি পথে কিছু জেলের দেখা পেলাম রাস্থা কতদূর জিজ্ঞেস যাকেই করেছি সবাই একই কথা বলেছিলো "এই তো বেশী না আর মাত্র দশ মিনিট"! এভাবে আমাদের দশ মিনিটের রাস্তা তিন ঘন্টায় শেষ হলো

***সমাপ্ত***

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছেরাপুঞ্জী-মৌসিনরাম ও গোয়াইন-সারি নদী বেষ্টিত সিলেটের অদ্যপ্রান্ত

পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে