সেই যে শুরু হলো করোনার ভাইরাসের তান্ডব জন-জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। এর ভিতরে যারা পেড়েছে টুকটাক ঘোরাফেরা করে নিয়েছে ঠিকই। চট্টগ্রামে থাকা অবস্থাই বন্ধ পেলেই ঘুরতে বের হয়ে যেতাম কিন্তু ঢাকা আসার পর সেটা আর হয়ে উঠে না। একদিনও যদি হাতে থাকে চিটাগং চলে যায় আপন মানুষগুলোকে একটু দেখবো বলে। যাই হোক অনেক ইচ্ছে ছিলো পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে ঘুরবো সারাদিন। কিন্তু কিছুতেই সময় আর সুযোগ দুটোকে এক থলের ভিতরে আনা যাচ্ছিলো না।
১৫ই অক্টোবর ২০২১ সাল। সেই মোক্ষম সময়টি পেয়ে গেলাম অনেক তদবির করার পর! তদবির করছিলাম ইউনিভার্সিটির এক ছোট ভাইকে। নাম সামিন। সেও আবার তার অফিসের কলিগদেরকে সময় দিয়ে রেখেছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা পেছালো হইতো আমার জন্যই!!!
সমস্যা হচ্ছে আমিও কিছু চিনি না আর ছোট ভাই সামিনও কিছু চেনে না। গুগুল বাবার উপর আস্থা রেখে ছোট ভাইকে বললাম তুমি পল্লবি থেকে একটা বাইক নিয়ে চকবাজার শাহি মসজিদের সামনে চলে আসো আমি বাড্ডা থেকে আসছি।
কথা মতো চকবাজার শাহি মসজিদের সামনে এসে পৌছালাম ঠিক সাড়ে দশটার কিছু পরে। এসে দেখি ছোট ভাই এখনো এসে পৌছায়নি। মসজিদের আশপাশ ঘুরতে ঘুরতে দেখি মূল গেইট খোলা। আমিও ঢুকে পড়লাম সুন্দর করে। খাদেমকে অনুরোধ করে একেবারে ভিতরে মিম্বারের সামনে চলে গেলাম।
চকবাজার সাহি জামে মসজিদ (মিম্বার)
চকবাজার শাহী মসজিদ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পুরান ঢাকা এলাকার চকবাজারে অবস্থিত একটি মোগল আমলের মসজিদ। মোগল সুবেদার শায়েস্তা খান এটিকে ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন, মসজিদে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে এই ধারণা করা হয়। এই মসজিদটিই সম্ভবত বাংলায় উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত প্রাচীনতম ইমারত-স্থাপনা।
চকবাজার শাহি জামে মসজিদ
মসজিদের ভিতর কিছুক্ষণ থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। আশেপাশে খোঁজাখুজির পর একজন পুরান ঢাকার মানুষের দেখা পেলাম। ঢাকাইয়্যা ভাষায় অনেক্ষণ কথা বললেন উনি। ভাষা গুলো শুনে একটু মজাই পাচ্ছিলাম তবে ভালোই লাগছিলো। চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটের ভাষার মতো দূর্বোধ্য না।
পুরানো ঢাকার বাসিন্দা
ছোটভাই সামিন এসে উপস্থিত এরই মাঝে। এসেই বললো ভাই মোবাইলে তো নেট নাই মনে হচ্ছে। একটু চিন্তা হচ্ছিলো কোন দিকে যাবো এটা ভেবে। বললাম একটা বৃদ্ধ দেখে রিক্সাওয়ালা খুঁজি চলো। খানিক অপেক্ষা করার পরই পেয়ে গেলাম আমাদের ভ্রমণের তৃতীয় সাথীকে। চাচার বয়স আনুমানিক ৫০-৫২, পুরান ঢাকারই মানুষ। মোটামুটি ভালোই চেনা উনার। আমাদের উদ্দেশ্যও এটাই ছিলো। চাচাকে বললাম চাচা বাহাদুর শাহ পার্ক, বলধা গার্ডেন, লালবাগ কেল্লা, লালবাগ শাহী মসজিদ, জিনজিরা প্রাসাদ, আহসান মঞ্জিল, বড়কাটরা, ছোটকাটর্ রোজ গার্ডেন, রূপলাল হাউজ, লালকুঠি, তারা মসজিদ, আর্মেনীয় গির্জ্ কসাইটুলি মসজিদ, মুসা খান মসজিদ, তারা মসজিদ, বিনত বিবির মসজিদ, রূপলাল হাউজ সব গুলোতে যেতে চাই, কোথা থেকে শুরু করলে ভালো হয়! চাচা আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হা হয়ে তাকিয়ে ছিলো। বললো সারাদিনই তো চলে যাবে গা এতো সব গেলে! আমি বললাম সেটা ব্যাপার না। আপনি কতো নিবেন? উনি অনেক চিন্তা করে বললো ঘণ্টায় দেড়শ দিবেন। বলে কয়ে ঘন্টায় একশতে রাজি করালাম।
চলেন চাচা কোথায় নিবেন প্রথমে...
চলেন লালবাগ কেল্লায় দিয়ে শুরু করি সেখান পরপর তিনটি জিনিস দেখতে পারবেন। লালবাগ শাহী মসজিদ, লালবাগ কেল্লা এরপর খান মোহাম্মাদ মৃধা মসজিদ। লালবাগ কেল্লার আগেই লালবাগ শাহী মসজিদ পড়ে, বর্তমানে সেটিতে আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে।
লালবাগ শাহি মসজিদ
লালবাগ শাহী মসজিদ, ঢাকার লালবাগ কেল্লায় যাওয়ার আগেই পড়বে। মসজিদটি নির্মাণ করা হয় ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে। তৎকালীন ঢাকার উপ-শাসক সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফর্রুখশিয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদটি নির্মিত হয়। এখানে থেকে একটু সামনেই লালবাগ কেল্লা। লালবাগ কেল্লায় পৌছিয়েই দেখি বিশেষ কারণে সরকার আজকে বন্ধ রেখেছে।
বড় একটা গেইট দেখতে পেলাম শুধু কেল্লার দক্ষিণ দিকে। আর বাহির থেকে যতোটুকুন দেখা যায়। সেখান থেকে চলে আসলাম আরো সামনে খান মুহাম্মাদ মৃধা মসজিদের সামনে। এখানে এসেই মন ভড়ে গেলো। লাল মাটি আর লাল মাটির ইট দিয়ে তৈরী সম্পূর্ণ মসজিদটি। মসজিদের নীচ তলায় অবশ্য এখন দখলে চলে গিয়েছে সম্ভবত। দেখলাম সংসারীক জিনিসপাতি। এসব জায়গায় আসলে এসব মানা যায় না।
খাঁন মুহাম্মাদ মৃধা মসজিদ
খান মহম্মদ মৃর্ধার মসজিদ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পুরানো ঢাকা এলাকার আতশখানায় অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। এটি ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে নায়েবে নাযিম ফররুখশিয়ারের শাসনামলে নির্মিত হয়। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মতে ঢাকার প্রধান কাজী ইবাদুল্লাহের আদেশে খান মহম্মদ মৃর্ধা এটি নির্মাণ করেন।
মসজিদের ভিতরের অংশ
খান মুহাম্মাদ মৃধা মসজিদ থেকে চাচা চলে আসলেন সরাসরি হোসেনী দালান রোডে। পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে যে জিনিসটি বেশি পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে বাখরখানির দোকান। আমরাও পেয়ে গেলে এরকম একটা দোকান।
এখানে রয়েছে হাতের ডান পাশে হোসেনী দালান দারুল কোরআন পাঠাগার আর বাম পাশে হোসনী দালান জামে মসজিদ। আমরা গেলাম দারুল কোরাআন পাঠাগারের ভিতর। সেখানে গিয়ে দেখি জুমার নামাযের আয়োজন চলছে। ভিতরে অনেক কিছুই দেখলাম। সেগুলোর কিছু ছবিও নিয়েছি। বিস্তারিত কিছু লিখছি না ধর্মীয় ইস্যু যেন না তৈরী হয় তাই।
ভয়ে ভয়ে নানা প্রশ্ন করে ছবি তুলে আল্লাহ আল্লাহ করে বের হয়ে আসলাম। এখান থেকে চললাম আরমানিটোলার কাছেই আবুল খায়রাত রোডে অবস্থিত তাঁরা মসজিদের দিকে। এখানে আসার মুখেই পড়বে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
ভিতরে ঢুকা যাবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম একজন রসহীন পুলিশ ভাইকে। দিলো না। রিক্সা চলতে থাকলো। সামান্য এগুতেই চোখে পড়বে বেগম বাজার জামে মসজিদ। এটিও চোখ এড়িয়ে যেতে পারবেন না আপনি।
বেগম বাজার জামে মসজিদ/করতলব খান মসজিদ
করতলব খান মসজিদ বাংলাদেশের পুরনো ঢাকার বেগম বাজার এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। এটি নওয়াব দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খান কর্তৃক নির্মণ করেছিলেন।
তাঁরা মসজিদের ভিতরের ও বাহিরের অংশ
তারা মসজিদ পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত। সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। মসজিদের গায়ে এর নির্মাণ-তারিখ খোদাই করা ছিল না। জানা যায়, আঠারো শতকে ঢাকার 'মহল্লা আলে আবু সাঈয়ীদ'-এ (পরে যার নাম আরমানিটোলা হয়) আসেন জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান)। ঢাকার ধণাঢ্য ব্যক্তি মীর আবু সাঈয়ীদের নাতি ছিলেন তিনি। মির্জা মসজিদ নির্মাণ করেন।
তাঁরা মসজিদ থেকে বেড়িয়ে চলে আসলাম আর্মানিটোলা ব্যাপটিস্ট চার্চের সামনে। প্রথমে ঢুকতে দিচ্ছিলো না, পরে একটু টেকনিক খাটিয়ে ঢুকে পড়লাম। মানে রেফারেন্স ব্যবহার করলাম একজনের।
আর্মানিটোলা গির্জা
আর্মেনীয় গির্জা পুরান ঢাকার একটি প্রাচীন খ্রিস্টধর্মীয় উপাসনালয়। এটি ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পুরানো ঢাকার আর্মানিটোলায় অবস্থিত।ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ঢাকায় অনেক আর্মেনীয় ব্যক্তির আগমন ঘটে। গীর্জা নির্মাণের পূর্বে ঐ স্থানে ছিলো আর্মেনীয়দের একটি কবরস্থান। এই গির্জার জন্য জমি দান করেন আগা মিনাস ক্যাটচিক।
জুমার নামাযের সময় হয়ে যাওয়ায় চার্চ থেকে বের হয়েই পাশেই একটা জামে মসজিদে ঢুকে পড়লাম ওযু করে দুই ভাই। নামায কালাম পড়ে চাচা মিয়াকে বললাম চাচা, খুদা লাগছে নান্না কাছে হবে না হাজী বিরানী কাছে হবে? উনি বললেন নান্নাটা কাছে হবে। চলে আসলাম নান্না বিরানীর কাছে। এসে দেখি নান্নার পাশেই হাজী বিরানী! পড়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানলাম সেটা আসল হাজী বিরানীর একটা শাখা।
হাজী নান্না বিরানী, বেচারাম দেউরী রোড, ঢাকা
খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাদের রিক্সা ভ্রমণের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো। চাচা এর ভিতরে স্টাডি করে ফেলছেন। বলে রেখেছিলাম বিউটি বোর্ডিংয়েও যাবো। আসার সাথে সাথে বলে উঠলো বিউটি বোর্ডিংইয়ের খবর পাইছি। যাইবেন না?
বললাম আগে এখানের গুলো শেষ করি এরপর। চাচা বললেন কই যাবেন এখন। বললাম বড় কাটারা আর ছোট কাটারা তো বাদ পড়ে গেলো! ওখানেই যাওয়া যাক। এরপর কসাইটুলি, নারিন্দা যাবো সাথে ফরাশ গঞ্জও আছে।
বেচারাম দেউরী রোড থেকে চকবাজারের ভিতরে মৌলুভীবাজার (কাচাবাজার) হয়ে আমরা চলে আসলাম বড় কাটরা। বড়কাটরা এসে একটু আশা হতো হলাম। দেখার মতো শুধু একটা তৎকালীন আমলের ইটের বিশাল গেইট ছাড়া কিছুই দেখছিলাম না। পড়ে স্থানীয় এক মুরব্বীর সাথে কথা বলে বুঝলাম গেইটের বাম পাশেই মূল ভবন। যদি উনার তথ্য মতে এটা জাহাঙ্গীর বাদশার প্রাসাদ কিন্তু আদতে তা ঠিক না।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা
যেমনেই হোউক ভবনে ঢুকাই লাগবে। এদিক ওইদিক করে অনেক ক্ষণ খুজলাম গেইট কোনদিকে। পরে না পেয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বললো মাদ্রাসার গেইটের ভিতর দিয়ে যাওয়া লাগবে। আচ্ছা, ঐ পুরনো ভবনের পাশেই একটা মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। মাদ্রাসার গেইটই এখন ওই প্রাসাদে যাওয়ার ফটক হয়ে গিয়েছে। গেইটের সামনে গিয়ে দেখি এক বৃদ্ধ দারোয়ান বসে আছেন। কিছুতেই ঢুকতে দিবেন না! উপায় না দেখে জোর করে ঢুকে গেলাম প্রিন্সিপালের রুমে। গিয়ে বললাম দূর থেকে আসছি, ইমারতের ভিতরে যাবো। বলার সাথে সাথে অনুমতি পেয়ে গেলাম!!!
বড় কাটরা
সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে দিওয়ান মীর আবুল কাসিম দ্বারা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়। তিনি মীর-ই-ইমারত নামে পরিচিত ছিলেন।
ভবনের ভিতরে যাওয়ার দরজা
ভিতরে যাওয়ার সিঁড়ি
ভিতরে এক প্রকার যুদ্ধাবস্থা, উঁচু উঁচু সিঁড়ি, আর খুফিয়া রুম। আপনাকে নিয়ে যাবে একেবারে মুঘল আমলের সময়ে। অনেক কষ্ট করে ভিডিও করেছিলাম কিন্তু এসে দেখি মোবাইলে সেই ভিডিওটি সেইভ হয়নি। খুব বেশি কষ্ট পেয়েছি, এখনও কষ্ট লাগছে।
যাই হোক তৃপ্তি নিয়ে বের হলাম ছোট কাটরার উদ্দেশ্যে। বড়কাটারার সামান্য দূরেই ছোট কাটারা। এখানে এসেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সম্পূর্ণ যায়গাটাই দখল হয়ে গিয়েছে ব্যবসায়ীদের হাতে। খোঁজাখুঁজি করতেই সিড়িটা পেয়ে গেলাম। আবাসিক হয়ে যাওয়াতে উপরে যেতে ভয় হচ্ছিলো। একজন বাসিন্দাকে অনুরোধ করে উঠে গেলাম আমরা দুজনই।
ছোট কাটারা
ছোট কাটারা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি ঢাকায় একটি ইমারত। এটির অবস্থান বড় কাটারার পূর্বদিকে হাকিম হাবিবুর রহমান লেনে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ইমারতটি দেখতে অনেকটা বড় কাটারার মত হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটারার চেয়ে ছোট।
দখল হয়ে যাওয়া ছোট কাটারা ইমারত
ছোটকাটারা থেকে বেড়িয়ে চলে আসলাম কসাইটুলীতে। এখানে আছে নাম করা কাস্বাবটুলি জামে মসজিদ। পুরান ঢাকার কসাইটুলির পিকে ঘোষ রোডে অবস্থিত শতবর্ষী একটি মসজিদ। স্থানীয়ভাবে এটি 'চিনির টুকরা মসজিদ' নামে পরিচিত। মূলত, মসজিদের গায়ে চিনামাটির সাদা টুকরাগুলো দেখতে চিনির দানার মতো হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা মসজিদটিকে এই নামে ডাকেন।
কাস্বাবটুলি জামে মসজিদ
কাস্বাবটুলি জামে মসজিদের ভিতরের অংশ
অযুখানা
কসাইটুলী থেকে আমরা এবার যাত্রা করলাম বাংলাবাজারের উদ্দ্যেশে, গন্তব্য শ্রীশ দাস লেনে অবস্থিত বিউটি বোর্ডিং। কসাইটুলী থেকে শ্রীশ দাস লেন আসতে দুটি রোড ব্যবহার করা যাবে। একটি বাবু বাজার ইসলামপুর কাপড়ের বাজার হয়ে। এখানে দিয়ে গেলে আপনার চোখে পড়বে আহসান মঞ্জিলের সংযোগ পুরোনো গেইট বা নবাব বাড়ী গেইট। এই রাস্তা দিয়ে সোজা চলে গেলে আহসান মঞ্জিল।
নবাব বাড়ি গেইট
আহসান মঞ্জিল গেইট
আহসান মঞ্জিল
আহসান মঞ্জিল পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারীর সদর কাচারি। বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি।তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন। আহসান মঞ্জিল থেকে কিছু দূর গেলেই পুরান ঢাকা নদী বন্দর ও সদর ঘাট লঞ্চ টার্মিনাল পড়বে।
পুরান ঢাকা নদী বন্দর
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল
সদরঘাটে কিছুক্ষণ থেকে আমরা রিক্সা নিয়ে সরাস্রি চলে আসলাম শ্রীশ দাস লেন, বাংলাবাজার। যেখানে বিউটি বোর্ডিং অবস্থিত। কেনো আমরা এই বিউটি বোর্ডিং খুঁজেখুঁজে এলাম? বিউটি বোর্ডিং বাড়িটি ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্বে সেখানে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। দেশভাগের সময় পত্রিকা অফিসটি কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। এরপর ১৯৪৯ সালে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই বাড়ি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। নলিনী মোহনের বড় মেয়ে বিউটির নামেই এর নামকরণ করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন। পরবর্তীতে প্রহ্লাদ চন্দ্রের পরিবার ভারত গমন করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতী প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিং আবার চালু করেন।
বিউটি বোর্ডিং এর জন্মলগ্ন থেকেই এখানে আড্ডা দিতেন প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
এখানে যারা আড্ডার আসরে আসতেন এদের মধ্যে কবি শামসুর রাহমান, রণেশ দাশগুপ্ত, ফজলে লোহানী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমেদ ছফা, হায়াৎ মাহমুদ, সত্য সাহা, এনায়েত উল্লাহ খান, আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ড. মুনতাসীর মামুন, ফতেহ লোহানী, জহির রায়হান, খান আতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদ, গোলাম মুস্তাফা, খালেদ চৌধুরী, সমর দাস, ফজল শাহাবুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শফিক রেহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী, ভাষাসৈনিক ও পুস্তক প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান।
বিউটি বোর্ডিং
বিউটি বোর্ডিং থেকে বেড়িয়ে আমরা চলে আসলাম বাহাদুর শাহ পার্কে। একেবারেই কাছে। বাহাদুর শাহ্ পার্কের এক পাশে কাজী নজরুল সরকারী কলেজ অন্যপাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
বাহাদুর শাহ্ পার্ক প্রাঙ্গন
আঠারো শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। যাকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আন্টাঘর। বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা আন্টা নামে অভিহিত করত। ক্লাব ঘরের সাথেই ছিল একটি মাঠ বা ময়দান যা আন্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই এ সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। সেই থেকে এই স্থানের নামকরণ হয় "ভিক্টোরিয়া পার্ক"। ১৯৫৭ সালের আগে পর্যন্ত পার্কটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকেরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সিপাহিকে। তারপর জনগণকে ভয় দেখাতে সিপাহিদের লাশ এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে। ১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১) সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। সিপাহী বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর শাসন পুনরায় আনার জন্য। তাই তার নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় "বাহাদুর শাহ পার্ক"। (wiki)
কাজী নজরুল সরকারী কলেজ
বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে বেড়িয়ে চললাম এবার ফরাশগঞ্জ। উদ্দ্যেশ্য নর্থব্রুক হল যা বর্তমানে লালাকুটি নামে পরিচিত।
নর্থব্রুক হল
ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যরিং নর্থব্রুক ঢাকা সফরে এলে এ সফরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই ভবনটি টাউন হল হিসেবে নির্মাণ করা হয়। এখানে একটি নাট্যালয় রয়েছে। তৎকালিন ঢাকার স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা গভর্নর জেনারেল নর্থব্রুকের সম্মানে এই ভবনের নাম দেন নর্থব্রুক হল। এখান থেকে বের হওয়ার সময় চোখে পড়বে ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের অফিস।
চাচা মিয়া আমাদের জন্য বসে রয়েছেন, উনার নেক্সট গন্তব্য নারিন্দা, চাচার এখন সব ঠিক্টহাক এগুচ্ছে। ভ্রমণ প্রায় শেষের দিকে কারণ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রিক্সা ছুটলো নারিন্দার দিকে। বিনত বিবির মসজিদে। কিছুদুর গিয়েই চাচা মিয়া হঠাৎ একটা মাজারের সামনে এনে রিক্সা থামিয়ে দিলেন। বললেন এটাই বিবির মাজার। আমি বললাম কি বলেন! মিলে না তো! তারপরও এসেি যখন পড়েছি তখন নেমেই দেখি বলে নামলাম। ভিতরে গিয়ে দেখি ছাগল মুরগী হালাল হওয়ার জন্য বসে আছে ভিতরে। ধূপের গন্ধে টিকতে না পেড়ে বেড়িয়ে এসে চাচা মিয়াকে বললাম এটা কি নারিন্দা নাকি চাচা? চাচা বললেন না। এবার একটু কর্কশ ভাবে বললাম ''চাচা নারিন্দায় চলেন। বুঝলাম চাচাও চালাক। সময় কিল করলো হাল্কা।
নারিন্দায় এসেই সামান্য এগুতেই চোখে পড়লো বিনত বিবির মসজিদ। বর্তমানে এর পাশেই বড় করে মসজিদ করা হয়েছে মূল মসজিদের ক্ষতি না করে। আমরা বিনত বিবির মসজিদে ঢুকে পড়লাম।
ভিতরটা অনেক ছোট।
বিনত বিবির মসজিদ
পাথরে খোদায় করে ফার্সী ভাষায় লেখা
গম্বুজের ভিতরের অবস্থা
নারিন্দা থেকে এবার যাওয়ার পালা বলধা গার্ডেন। বলধা গার্ডেনে যখন এসে পৌছুলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে ছুইছুই করছে মাদের ভ্রমণকে। পুরান ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত এটি একটি উদ্ভিদ উদ্যান।
বলধা গার্ডেন
পুরান ঢাকার ওয়ারীতে অবস্থিত এটি একটি উদ্ভিদ উদ্যান। বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এই উদ্যানটি নির্মাণের কাজ আরম্ভ করেন। যা শেষ হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৮ বছর। বিরল প্রজাতির ৮০০ গাছসহ বাগানটিতে প্রায় ১৮ হাজার গাছ রয়েছে। বর্তমানে এখানে ৬৭২ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।
আমাদের ঝুলিতে তখনো প্রায় পড়ে রয়েছিলো জিঞ্জিরা প্রাসাদ, জিঞ্জিরা মার্কেট, মূসা খাঁর মসজিদ, হাজী শাহ্বাজ মসজিদ, রোজ গার্ডেন, রূপলাল হাউজ সহ আরো অনেক নাম না জানা স্থান। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই খ্যামা দেওয়া লাগলো। চাচাকে বললাম চাচা কিছু খাওয়ান এবার। কোথায় নিবেন?
চাচা মিয়া চলে এলেন স্টার হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে। এখানকার খাবার গুলো ভালো আর ওয়াটার গুলোর ব্যবহারও চমৎকার। যাই হোক ঐদিনের মতো সন্ধ্যের খাবারের পর ছোট ভাই সামিনকে বিদায় দিয়ে আমাদের পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে ভ্রমণের ইতি টানলাম।
আহমাদ যুবায়ের ২০১৮ পর আবার সুযোগ আসলো সিলেট ট্যুরের , আসলো বললে ভুল হবে , করে নিতে হলো। চট্টগ্রামে বাসস্থান হওয়াতে সিলেটের মতো দূরের ট্যুরের জন্য আসলেই অনেক পরিশ্রম করা লাগে শুধু মাত্র সফরসঙ্গী যোগাড় করতেই। সেক্ষেত্রে এবারের ট্যুর ম্যাট হিসেবে আমাদের সর্ব শেষ ট্যুর ‘বাঁশখালীর’ ট্যুর ম্যাটদের সহজেই পেয়ে গেলাম। অর্থ্যাৎ আরমান,সোহেল, শিবলী ও আতা মামা।ঈদের ছুটিতে ট্যুর মানেই টিকেট সংকট। যথারীতি আমাদের ম্যানেজার আরমান শিবলীকে সঙ্গে নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টাই আগষ্ট ১৪ তারিখ রাতের ট্রেনের টিকেট ম্যানেজ হলো। গেলো বার বাসে যাওয়ায় সিলেট রুটের ট্রেন সম্পর্কে কোনরূপ ধারণা ছিলো না। ১৪ তারিখ রাতে সবাই উপস্থিত চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে, ট্রেনের বগির চেহারা দেখে আমাদের সবার মন খারাপ, উপায় নেই । যাত্রা শুরু হলো জাস্ট টাইমেই । গল্প আড্ডার সাথে সাথে আমাদের ট্রেন চলছে-যাত্রার এক পর্যায়ে বললাম ‘যাওয়ার সময় এই ট্রেনকেই সবাই মিস করবি দেখিস!’ সবাই বললো কেনো? বললাম সিলেটে তো যাচ্ছি ফিরতি টিকেট কিন্তু পাবো না এটা মাস্ট! আসার সময় যা ব্যবস্থা হয় তাতেই আসা লাগবে তবে বিআরটিসির টিকেট পাওয়া যাবে। সবার মাথায় ...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন