সুনামগঞ্জের পথে ঘাটে

আহমা যুবায়ের
প্রায় আড়াই বছর প্রতীক্ষার পর বন্ধু শরীফের মারফৎ সুনামগঞ্জ যাওয়ার একটা সুযোগ হলো ২০১৮ সালের ২৫শে আগস্ট। সফর সঙ্গী হিসেবে শরীফকে না পেলেও তাঁর কাছে বন্ধু সাগরকে পেলাম, এই ট্যুরে প্রথম পরিচয় সাগরের সাথে, খুবই মিশুক প্রকৃতির। সহজেই আপন করে নিলো। ট্যুর লীড দিলো ঋয়াদ, বাসের টিকিট সেই ব্যবস্থা করলো দিনে দিনে যেটা ছিলো অসম্ভব, যেহেতু ঈদের ছুটির সময়। আরো ছিলো মুন্তাসির,ইমতিয়াজ (টিমের ম্যানেজার কাম অর্থ সম্পাদক), ফরহাদ আর মুরাদ।সময়টা ছিলো বর্ষাকাল, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, আবহাওয়াটা চমৎকার ট্রাভেলিংয়ের জন্য।

চট্টগ্রাম থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য আপনি ট্রেন থেকে বাসকে গুরুত্ব দিবেন বেশি, কারণ ট্রেন সিলেট পর্যন্ত, সিলেট থেকে আবার আপনাকে বাস ধরতে হবে সুনামগঞ্জের যেটা টাইম কিলিং ব্যাপার।
যাই হোক উদ্দেশ্য ঠিক থাকলেও আমরা সরাসরি সুনামগঞ্জের টিকিট পেলাম না। সিলেট থেকেই আবার বাস ধরতে হলো আমাদের। সকাল ছয়টা কি সাড়ে ছয়টায় সিলেট নামিয়ে দিলো চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা রাত দশটার বাস।
সুনামগঞ্জ যাওয়ার জন্য লোকাল সিএঞ্জি করে কুমারগাও বাস স্টেশন পৌছুলাম। বাস স্টেশনের উল্টো দিকের হোটেলে সকালের নাস্তাটা সেড়ে বাসে উঠে পড়লাম। লোকাল বাস। বাস চলছে তো চলছেই, রাস্তা আর ফুরোই না। বর্ষাকাল হওয়ায় বিলে বিলে পানিতে ভরপুর, ছোট ছোট হাওড় বাওড় আর খাল, এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ চারপাশে। প্রায় আড়াই ঘন্টার বাস ট্রাভেলের পর আমরা এসে পৌছুলাম সুনামগঞ্জ নতুন ব্রীজ বাস স্টেশন সুনামগঞ্জ নেমে সরাসরি টমটমে করে সুনামগঞ্জ বাজারে গিয়ে রিটার্ন টিকিট কনফার্ম করে ফেলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যেহেতু ব্যাকোয়ার্ড জায়গা সহজে টিকিট পাওয়াও যায় না ট্যুরিস্ট সিজনে। আমাদের ভিতর দুজন বাজারে গিয়ে টিকিট না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসলো, সবাই একটু চিন্তিত হয়ে গেলেও আমি বললাম পেছনে তাকিয়ে লাভ নেই, এসেই যখন পরেছি যা হবে দেখা যাবে। এরপর সবচেয়ে কষ্টের অধ্যায় শুরু সুনামগঞ্জ নতুন ব্রীজ বাস স্টেশন থেকে তাহিরপুর বাজার যাওয়ার জন্য লেগুনা ভাড়া করা।এক্ষেত্রে একটু কৌশলী হতে হবে যেন ভাড়া হাজার বারোশর বেশী না যায়। লেগুনা চলতে শুরু করলো আমাদের, আসেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা যাচ্ছি, পথিমধ্যে লেগুনা থামিয়ে সুনামগঞ্জের পথ ঘাটের সাথে ছবি নেওয়াও চলছিলো। দেড় ঘণ্টার মতো লেগুনায় চড়ার পর আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত টাংগুয়ার হাওরের প্রথম স্থান তাহিরপুর বাজার এসে পৌছুলাম। সামান্য হেটে তাহিরপুর নৌকাঘাটে পৌছুলাম।
তাহিরপুর নৌকার ঘাট
মাঝারি তবে ছোটও না এরকম একটি নৌকা ঠিক করে নিলাম (পয়ঃনিষ্কাশন চুলার ব্যবস্থা সহ) সাড়ে তিন হাজার দিয়ে দুই দিন এক রাতের জন্য। বাজার সধাই সব আমরা করে দিলাম মাঝিকে নিয়ে। আমরা যারা সাতার জানতাম না তারা বাজার থেকেই পঞ্চাশ টাকা দিয়ে লাইফ জ্যাকেট ভাড়া করে নিলাম।টাংগুয়ার হাওর দিয়ে নৌকা যাত্রা শুরু হলো আমাদের।
টাংগুয়ার হাওর
তখন বেলা প্রায় পড়ে এসেছিলো, তাই ঠিক করা হলো দুপুরটা ওয়াচ টাওয়ারে গোসল দিয়ে সন্ধ্যায় নীলাদ্রী লেকে কাটাবো যা মূলত শহীদ সিরাজ লেক। এটি চুনা পাথর আহরণের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলো। বর্তমানে এটি পরিত্যাক্ত হলেও যখন লেকের উপর পাহাড়ের পাশ দিয়ে সূর্য অস্থিমিত হতে থাকে লেকের পানি সূর্য রশ্মীর প্রতিসরণ আর প্রতিফলনের কারনে রঙ পরিবর্তন হয়ে লাল নীল বেগুনীর এক মিশ্রণে প্রকাশিত হয়।ওয়াচ টাওয়ারে নৌকা শুধু ভেড়ানোর দেরি একলাফে সবাই পানিতে, কেবল আমি আর সাগর ছাড়া।
ওয়াচ টাওয়ার
আমাদের নৌকা ওয়াচ টাওয়ার হয়ে ট্যাকের ঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করলো, ইমতিয়াজ নৌকার উপর মুরগী জবাই দিলো রাতের আহারের জন্য।টেকের ঘাট পৌছানোর পর মাঝিকে বলা হলো রাতের খাবার তৈরী করে রাখতে আমরা ঘুরে আসছি। নীলাদ্রী লেক কাছেই, হেটেই পৌছানো যায়, পাথুরে চুনা আনা নেওয়ার জন্য নির্মিত রেল লাইন ক্রস করলেই নীলাদ্রী লেক। সন্ধ্যাটা সেখানেই পার করলাম মশা,পিপড়ার কামড় খেতে খেতে আর নীলাদ্রীর সৌন্দর্য্য দেখে।
নীলাদ্রীর কোলে অস্তমিত  সূর্য
সন্ধ্যা নেমে এলো, আমরা সবাই টেকের ঘাট বাজারে ঢুকলাম, এখানে সুবিধা মতো একটা দোকানে ঢুকে মোবাইলে চার্জ দেওয়া আর হাল্কা নাস্তা গল্প গুজব শুরু করে দিলাম, উদ্দেশ্য টাইম পাস করা কারণ রাত হয়ে যাওয়ায় আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। আকাশের অবস্থাও সুবিধার ছিলো না।মোবাইল চার্জ দশ টাকা, পাউয়ার ব্যাংক বিশ টাকা। উপায় নেই, করানো লাগবেই। শুরু হলো আড্ডাবাজি। আমি ছাড়া সবাই একে অপরের পূর্ব পরিচিত, তারপরও সমস্যা হচ্ছিলো না, গল্প চলছে তো চলছেই।
রাত দশটা দিকে সবাই নৌকায় উঠে এলাম একবারে মাছাংয়ের উপর। মাঝি নৌকা ছাড়লো, হাওরের মাঝে একটা খুটির সাথে নৌকা বাধালো, পাশে আরেকটা নৌকা বাধা, আমাদের মাঝির পরিচিত, আজকে রাতে আমাদের অতিথি। ভরা পূর্ণিমার রাত, মৃদ্যু মন্দ বাতাসের সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে আমরা খেতে বসলাম। অসাধারণ এক অনুভূতি, লিখে শেষ করা যাবে না যা।নৌকা থেকে দেখলাম পাহাড়ের কিনারা ঘেষে ভারতের সীমান্ত জুড়ে রংবেরঙের সীমানা পিলার জ্বলে উঠতে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু পর ঘুমোতে চলে আসলাম নৌকার ভিতর।
নৌকা্য খাওয়ার আয়োজন/সাগর
সীমানা পীলা্র/ইমতিয়াজ
মেঘাচ্ছন্ন পূর্ণিমা্র চাঁদ
পরদিন সকাল সকাল উঠে মাঝিকে নৌকা কিনারায় লাগাতে বললাম, অর্থ্যাৎ আবার সেই ট্যাকের ঘাটে। বাজারে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নিলাম গরম গরম পরটা বাজি ডিম দিয়ে। প্রাকৃতিক ডাকে সারাও দিয়ে ফেললাম, এবার বাইক ভাড়া করতে হবে, উদ্দেশ্য-
. লাকমাছড়া . শিমুল বাগান . যাদু কাটা নদী . বারিক্কা টিলা . রাজার হাজং নামক পাতি ঝর্ণা।

আমরা কয়েক জন গেলাম বাইক ভাড়া করতে। ঠিক হলো চারটা বাইক ২৫০ টাকা করে। লাকমাছড়া ছাড়া বাকী সব স্পট ট্যাকের ঘাটের বাম দিকে আর লাকমাছড়া হলো ডান দিকে। রিয়াদের প্ল্যান অনুযায়ী আমরা ঠিক করলাম লাকমাছড়ায় আগে যাবো। আমি আর সাগর এক বাইকে, ঋয়াদ-ইমতিয়াজ, ফরহা-মুরাদ আর মুন্তাসির সিঙ্গেল এক বাইকে উঠলো।শুরু হলো আমাদের বাইক রাইডিং।
মেঘালয় পর্বতমালা/মানিক গাঁও

ভারতের মেঘালয় পর্বতমালা থেকে প্রবাহিত ঝর্ণাধারার পানি নেমে ছড়া হয়ে নাম হয়েছে লাকমাছড়া। দূর থেকে দেখা যায় ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সীমানা সেতু।বিভিন্ন বয়েসী নারী পুরুষ কয়লা আহরণকারী শ্রমিকদের দেখতে পাওয়া যায় সব সময়। আমরা তাদের কয়লা আহরণের পদ্ধতি দেখছিলাম।
ছড়া থেকে কয়লা আহরোণ

ছড়ার পানি অসম্ভব রকমের শীতল।আসতে মন চাচ্ছিলো না, তবুও ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছড়ার পানি থেকে উঠে বাইকে চেপে বসলাম।
আমাদের টীম/লাকমাছড়া/ঋয়াদ

বাইক চেপে তাহিরপুর দেখতে লাগলাম, বিশাল বিশাল পাহাড় ঘেষে ভারতীয় সীমানার পাশ দিয়ে চলছে আমাদের বাইক।বাইক এসে থামলো যাদুকাটা নদীর অদূরে মানিগাঁও গ্রামে জয়নুল আবেদীন নামের এক ব্যবসায়ীর হাতে তৈরী করা শিমুল বাগানের কাছে। অপরূপ সবুজে ঘেরা শিমুল বাগান। এখান থেকে দেখা যায় বারিক মিয়া টিলা আর যাদু কাটা নদী দুটোই।
মেঘালয়-জাদুকাটা নদী-শিমুল বাগান
কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা করে বাইক নিয়ে উঠে আসলাম বারিক মিয়া টিলা / বারিক্কা টিলার পাদদেশে।হেটে উঠলাম টিলার উপরে। টিলা থেকে যাদু কাটা নদী আর তাঁর পাশের শিমুল বাগানের দৃশ্য অন্যরকম সুন্দর মনোরম।
বারিক্কা টিলা হতে যাদুকাটা নদী ও শিমুল বাগান
বারিক্কা টিলা দিয়ে হাজং ঝর্ণার পথ যখন ধরলাম পথিমধ্যে খবর আসলো ঝর্ণায় কি সমস্যা হয়েছে যাওয়া যাবে না। তারপরও গেলাম, ঝর্ণা বলে আসলে কিছু না, একটা অতি ছোট পাতি ছড়া যা মনিপুরীরা গোসল রান্নাবাটি করার জন্য ব্যবহার করে থাকে। এক মনিপুরীর সাথে কথা বললাম। বললো একটু উপরে উঠলেই ভারত, যাওয়া মানা ঐদিকে।
হাজং ঝর্ণা/খৃষ্টান ধর্মালম্বী মনিপুরী
ঘুরা ফেরা শেষ করে দুপুর নাগাত নৌকায় এসে পৌছুলাম, হাতে অনেক সময় বেঁচে গিয়েছিলো, ঠিক হলো সিলেট জিন্দাবাজা গিয়ে হাসন রাজার বাসা যা বর্তমানে মিউজিয়াম করা হয়েছে সেখানে যাবো। সুনামগঞ্জের সব গাড়ির ড্রাইভারই হাসন রাজার বাসা চিনে। তাই বেগ পেতে হলো না আর। রাজার নাতির ঘরের পুতি (দেওয়ান তালিবুর রাজা ভাষ্য মতে) বেশ হাসি খুশি আর মিশুক প্রকৃতির মানুষ। উনার কাছ থেকেই জানলাম বর্তমানে হাসন রাজা নাম দিয়ে যে ছবি মানুষকে দেখানো হয় সেটি আসলে পাকিস্তানের অভিনয় শিল্পী হেলাল খানের ছবি। আসল হাসন রাজার ছবির সাথে তাই একটা স্থির চিত্র নিয়ে নিলাম সবাই।

দেওয়ান তালিবুর রাজা, হাসন রাজার প্রপৌত্রের সাথে আমরা
এবার ঘরে ফেরার পালা, ঈদে ছুটি শেষ, তাই কোথাও কোন টিকিট নেই সুনামগঞ্জ থেকে। চলে আসলাম সিলেট মূল শহরে, এখানে একই সমস্যা। এমন কোন টিকিট কাউন্টার বাদ রাখলাম না যেখানে খোজ নেওয়া হলো না। রাত ১১টার দিকে আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনটি বিআরটিসির টিকেট পাওয়া গেলো সরাসরি চট্টগ্রামের।আমার তাড়া ছিলো বেশি, তাই সর্বসম্মতিক্রমে আমার নাম আসলো তিনজনের মাঝে। আমরা তিন জন সেকেন্ড বাস স্টপেইজ থেকে বাসে উঠে দেখি বাকি চারজন বাসের ভিরত সামনের সিটে! কাকতালীয় ভাবে অন্যযাত্রী টিকিট ক্যান্সেল করায় তারা ফার্স্ট কাউন্টারেই চারটা টিকেট পেয়ে যায়। যাক সবাই এক সাথে এক গাড়ীতেই ফিরছি এটা বড় ব্যাপার।
****সমাপ্ত***

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছেরাপুঞ্জী-মৌসিনরাম ও গোয়াইন-সারি নদী বেষ্টিত সিলেটের অদ্যপ্রান্ত

পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে