রাঙামাটি ও কক্সবাজারের মিশ্রণঃ বাঁশখালী

আহমাদ যুবায়ের


১৪ই জুন ২০১৯ সাল জুমাবার আমি, আরমান, সোহেল, শিবলী আর বখতিয়ার মামা পাঁচজনের টিম নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বাঁশখালী এক্সপ্লোরের উদ্দ্যেশে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে বাঁশখালীকে আলাদা করা একমাত্র নদী সাঙ্গু বা শঙ্খ নদী যার বিস্তৃতি বান্দরবন মদক এলাকা, নদীর উপর করা হয়েছে শঙ্খ ব্রীজসর্পিলাকার এই নদী এসে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। চট্টগ্রাম থেকে খুব কাছে হওয়া সত্ত্বেও বাঁশখালী কখনো আসা হয়নি এর আগে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে বাঁশখালী সুপার সার্ভিস নামক কিছু ক্লোজ ডোর পরিবহন আছে ৮৫টাকা করে বাঁশখালীর চাঁদপুর থেকে ছনুয়া পর্যন্ত নিয়ে যায়। বাঁশখালী না গেলেও এর মানচিত্র মোটামুটি আমি মুখস্থ করে নিয়েছিলাম কারণ ট্যুর লীড করার গুরু দায়িত্বটা আমার উপরেই ছিলো আর আরমানকে করে দিলাম ট্যুরের ম্যানেজার। সবাই টার্মিনালে পৌছুতে পৌছুতে সকাল সাড়ে আটটা বেজে গেলো। গাড়িতে উঠে কন্ট্রাক্টরকে বলে দিলাম ‘চাঁদপুর’ এলে যেন আমাদের নামিয়ে দেয়। মিনিট পয়ত্তালিশ আমাদের গাড়িয়ে যখন শঙ্খ ব্রীজ ক্রস করছিলো, তখন দেখতে পাচ্ছিলাম বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ নদী।শঙ্খ নদী।

 ব্রীজের উপর থেকে শঙ্খ নদী

চাঁদপুর নামার প্রধাণ উদ্দেশ্য ছিলো বৈলগাঁও চা বাগানে যাওয়া। চাঁদপুর থেকে লোকাল সিএনজি প্রতিজন ৩০টাকা করে নেয়, আমরাও এরকম একটা সিএনজি দেখে উঠে পড়লাম।বৈলগাঁও চা বাগান বাহিরে থেকে ছোট মনে হলে এটি রামগড় থেকে কয়েকগুণ বিস্তৃত।

 বৈলগাঁও চা বাগান
চা বাগান থেকে বের হয়ে সিএনজি নিলাম আবার চাঁদপুর ফিরে আসার জন্য।সেখান থেকে সরাসরি ‘গুণাগুরি’ হয়ে মোশাররফ আলী মিয়ার বাজারের উদ্দেশ্যে যা স্থানীয় বিকৃত ভাষায় ‘মুইশালীর বাজার’ নামে পরিচিত। স্থানীয়দের ঠিকঠাক ভাবে নির্দেশনা না দিলে তারা ‘বাহারছড়া’ সংলগ্ন সৈকতেই নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিলো বাঁশখালীর শুরু খানখানাবাদ সৈকত হতে হেটে বাহারছড়া এবং সময় সংকুল হলে সরল হয়ে গন্ডামারা অব্দি হেটেই পাড় হওয়া।


যায় হউক সিএনজি মোশাররফ আলীর বাজার নিয়ে আসলো ২০০টাকার বিনিময়ে, সেখান থেকে ৭৫/- ভাড়ায় পৌছুলাম কাঙ্খিত খানখানাবাদ বেড়িবাধের সামনে। তখন বাধ সংলগ্ন মসজিদে জুমার ওয়াজ চলছিলো, ঠিক করলাম নামাজটা পড়েই পরবর্তী ভ্রমণ শুরু করা যাবে।
 খানখানাবাদ বেড়িবাদের পেছনের অংশ

নামাজ পড়ে দুপুরের ভাতের খোজ করলাম, আফসোস সেখানে তেমন কোন হোটেলের সন্ধান পেলাম না আমরা। হাল্কা পাতলা শুকনো খাবার আর পানি নিয়ে বেড়িবাধের উপর উঠে পড়লাম। বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো বাধের ওপারে যেন আমাদের জন্য! বিশাল বাধের নীচে সৈকতের দেখা মিললো আর বিশাল সমূদ্রের ঢেউ গুলো দূরে সরে সরে যাচ্ছিলো, বুঝলাম ভাটার সময় হয়ে গেছে। জেলেরা লাইন ধরে নেমে পড়ছিলো সাগরের বুকে জীবিকার তাগিদে।


খানখানাবাদ বেড়িবাধ


পরবর্তী গন্তব্য হাতের বামদিকে ‘বাহারছড়া সৈকত’। ঝাউবনে ঘেরা সমূদ্র সৈকতে আমরা কজন হেটে যাচ্ছিলাম অদূর প্রান্তে যার শেষ কবে হবে সেটা শুধু হাতের সময়ই বলে দিবে।



খানাখানাবাদ সংলগ্ন ঝাউবন

ঘন্টা খানিক হাটার পর পৌছুলাম বশির আলী মিয়া বাজার সংলগ্ন (স্থানীয় বিকৃত ভাষায় বুইশালীর বাজার) ‘বাহারছড়া সৈকতে’। এদিকের যায়গাটার প্রসংশা শুনলেও আমার খানখানাবাদের সৈকতই বেশি পছন্দ হয়েছিলো।


বাহারছড়া সমূদ্র সৈকত

ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটা সময় শেষের দিকে। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সৈকত ভ্রমণের এখানেই ইতি টেনে উঠে পড়লাম বাজারে। একজন থেকে জিজ্ঞাস করলাম ‘শিলকূপ’ যাওয়ার উপায় কি? সে আমাকে যা বললো তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ! বলে কিনা আমাদের আবার গুণাগুরি যেতে হবে! আমি বললাম কি বলেন সেখান থেকেই তো আসলাম! সোহেল আমার দিকে তাকিয়ে বলে-তুই উল্টো রাস্তায় আনছিস আমাদেরকে! আমি বুঝছিলাম না কি করবো মানচিত্র তো বলে আমি ঠিক আছি এই বালক আমাকে কি শোনাচ্ছে। একটু অপেক্ষা করার পর একটা সিএনজি আসতে দেখলাম যাত্রী নামিয়ে দাড়ালো সবে। বললাম ভাই শিলকূপ যাবেন? সে বললো শিলকূপ কোথায় যাবেন? বললাম ‘ইকো পার্ক’ চিনেন? বললো হুম যাবো। আমি একটু সিউর হওয়ার জন্য বললাম শিলকূপ ইকোপার্কই তো? নাকি নাপোড়া তারেক ইকোপার্ক? সে হেসে বললো ভাই ইকোপার্ক একটাই বাঁশখালীতে আর সেটা শিলকূপে। নাপোড়ারটা তারেকপার্ক। যাক বাবা রাস্তা ঠিক আছে-সোহেলের দিকে একটু তাকালাম। দরদাম করে উঠে পড়লাম ‘শিলকুপ ইকোপার্কের’ উদ্দেশ্যে। জলদী ফেলে আমরা যখন ইকোপার্কের সামনে তখন ঘড়িতে বিকেল চারটা। হাল্কা নাস্তা আর চা খেয়ে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম আমাদের শেষ গন্তব্যস্থানে। সময় কম হওয়াতে ঝুলন্ত ব্রীজ (সর্বদীর্ঘ কাটের তৈরী) ও ওয়াচ টাওয়ারে উঠে শেষ করলাম এ যাত্রা। উল্লেখ্য ব্রীজের অপর প্রান্তে পাহাড় থেকে বন্যহাতির দেখা মিলছে কারো কারো সেখানে। ওয়াচ টাওয়ারের শীর্ষ থেকে দেখতে পাওয়া যায় কুতুবদিয়া চ্যানেল।


ঝুলন্ত ব্রীজ ও ওয়াচ টাওয়ার

সবুজে ঘেরা বাঁশখালীর পাহাড়ি অঞ্চল আর সাগর বিস্তৃত জলরাশি যেন পার্বত্য রাঙামাটি আর কক্সবাজারের কথাই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন শুধু সৈকত সংলগ্ন সড়ক গুলোর একটু বেশী উন্নয়ন।


***সমাপ্ত***

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছেরাপুঞ্জী-মৌসিনরাম ও গোয়াইন-সারি নদী বেষ্টিত সিলেটের অদ্যপ্রান্ত

পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে