দুপ্রু ঝিরি পথ হয়ে মারায়ন থং ঝর্ণা এবং তুক অ দাম তুয়া


আহমাদ যুবায়ের

বৃহঃস্পতিবার অফিস থেকে বাসায়ফিরছিলাম আমি আর সাঈফুদ্দীন ভাই একই গাড়িতে করে। খুব শক্ত করে ধরলাম সামনের শনিবার বন্ধ,তাই বন্ধটা কাজে লাগাতে চাই,চলেন কোথাও ট্যুর দিয়ে আসি। ২০১৭ সালের গাড়িতে বসে বসে চিন্তা করছিলাম কোথায় যাওয়া যায়, অনেক গুলো নামের ভিতর শেষমেষ এসে ঠেকলো বান্দরবন যাবো।গন্তব্য দামতুয়া ঝর্ণা। আমি খুব এক্সাইটেড। ২৯ সেপ্টেম্বর জুমাবার ২০১৭ সাল, সকাল বেলা বের হতে হতে দেড়ি হয়ে গেলো যাবো কি যাবো না করতে করতে। তখন সাঈফুদ্দীন ভাই নতুন বিয়ে করেছিলেন, তাই ভাবীকে মানিয়ে বের হতে হত উনার দশটা বেজে গিয়েছিলো। নানা অনিশ্চয়তার মাঝে চকরিয়ার গাড়িতে উঠলাম বেলা তখন এগারোটা।দুপুর একটার দিকে চকরিয়া বাজারে পৌছে জুমার নামাজ শেষ করে আলীকদমের জীপে উঠে পড়লাম আমি আর সাঈফুদ্দীন ভাই। আকাশ মেঘলা ছিলো তাই জার্নি ভালোই লাগছিলো। সাইফুদ্দীন ভাই জীপের বাহিরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন ভেতরে যায়গা না হওয়ায়। আমাদের জীপ তখন লামার দিকে ছুটছে হঠাৎ আকাশ কালো করে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো, সাইফুদ্দীন ভাই ভিজছিলেন বাহিরে। লামার রাস্তা গুলো এতোই উচুতে যে রাস্তা এপাশ-ওপাশ দুটোই খাঁদ। জীপ স্লীপ করে কোন এক পাশে পড়লে গল্প শেষ সেখানেই। আলীকদম পৌছে আমরা সমতলের দেখা পেলাম।
আলী কদম সমতল থেকে মারায়ন থং পাহাড়ের চূড়া
আলীকদমে আমরা সাঈফ ভাইয়ের ফুফির বাসায় উঠলাম। আমাদের অনেক আপ্যায়ন করলেন সাধ্যের মধ্যে। বিকেল বেলা বের হলাম আলীকদম ঘুরে ফিরে দেখবো বলে। ফুফি বারবার বলছিলেন এখানেও নাকি ছোট একটা ঝর্ণা আছে। দূর থেকে ''মারায়ন থং'' পাহাড় দেখা যাচ্ছিলো, চূড়াই উঠার প্লেন করলেও বাদ দেওয়া লাগলো সময়ের অভাবে।দূর পাহাড়ে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো।ফুফির বর্ণনা মতো ''দুপ্রু ঝিরি'' পথ ধরে মারায়ন থং পাহাড়ের ঝর্ণার খোজে বেরিয়ে পড়লাম।
মারায়ন থং পাহাড়ের আদা চাষী

ট্রাকিং করতে করতে একটা সময় ঝিরির পানির শব্দ বেড়ে গেলো, বুঝলাম কাছাকাছি চলে এসেছি।না, অতোটা ছোট না, মোটামুটি রকমের একটা ঝর্ণার দেখা মিললো। বাংলাদেশ আর্মি এই ঝর্ণা থেকেই আলীকদম গ্রামের জন্য পানি নেওয়ার সুব্যবস্থা করে দিছে পাইপের মাধ্যমে।আদা চাষীদের ব্যবহার আর লাজুকতা আমাদের অবাক করলো।
মুরং আদা চাষী

সময় অল্প হওয়ায় কিছুক্ষণ সময় থেকে ফিরতি পথ নিলাম পরের দিনের ট্যুর প্রস্তুতির জন্য।
মারায়ন থং ঝর্না
পরদিন শনিবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ছুটলাম আলীকদম পান বাজারের দিকে।বাইক ঠিক করে সেখান থেকে গেলাম ১৭ কিলো মিটার রাস্তার শুরু আর্মি হেড কোয়ার্টারে অনুমতি নিতে। মিনিট বিশেক অপেক্ষার পর অনুমোদন পেয়ে গেলাম।বলাবাহুল্য পান বাজারে বাইক ঠিক করার সময় আমাদের সাথে চারজনের আরেকটি গ্রুপের সাথে পরিচয় হয়ে যায় যাদের গন্তব্যও আমাদের সাথে মিলে যায় অর্থাৎ "দামতুয়া"
আমাদের ছয়জনের তিনটা বাইক নিয়ে শুরু হলো এক কিলো থেকে ১৭ কিলো পর্যন্ত বাইক রাইডিং।
উচু নীচু পাহাড়ি রাস্তা পেড়িয়ে যখন ১৭ কিলো আর্মি ক্যাম্পে পৌছুলাম তখন ঘড়িতে সাড়ে ১০টা। একজন সৈনিক এসে বললো অবশ্যই যেনো আদু পাড়া থেকে স্থানীয় গাইড নিয়ে যাই।বাইক আদু পাড়ার দিকে চলা শুরু করলো। বিশ্বাস যাবেন কিনা জানি না, সতেরো কিলোর এপার যেন বিংশ শতাব্দীর শহর হলেও ওপার যেন পুরোই আদীম! আদুপাড়া পর্যন্ত বাইক এসে নামিয়ে দিলো, ফেরার সময় আবার নিয়ে যাবে।আমাদের গাইড ঠিক হলো নাম নিধু দা। খুব মিশুক। আদুপাড়ার রাস্তার উপর থেকে বাম দিকে নেমে গেলো নিধু আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে, বুঝলাম আমাদের আসল ট্রাকিং এখান থেকেই শুরু।
আদু পাড়া মূলত মুরংদের। অন্ন বস্ত্র বাসস্থান বা শিক্ষার আলো কোনটাই এখানে পৌছাইনি বলা যায়। আমরা হাটছি নিধু দার পিছুপিছু, সমতল পেড়িয়ে পাহাড়ে, পাহাড় ভেঙ্গে ঝিরি পথে। 
ট্রেকিং চলছে
লিখে বুঝানো যাবে না কি পরিমাণ কষ্টকর ট্রাকিং ছিলো আমার জন্য।ঝিরির পানিতে পা ভিজে পিছলা খাচ্ছিলাম বারবার, সেন্ডেলে পা রাখতেই পারছিলাম না, কাদাকাদা হয়ে যাচ্ছিলো।একবার হাতে নিয়ে হেটে দেখলাম, না পিছলার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।হাসফাস করতে করতে ট্রাকিং চলছিলো। 
দূর্গম ঝিরি পথ
তারপরও বন্ধ করলাম না, চালিয়ে যাচ্ছিলাম।ট্রেকিং করার এক পর্যায়ে দূর থেকে দেখতে পেলাম পাহাড়ের গা ঘেষে সুন্দর ছিমছাম এক "জুম ঘর" এটাই দাম তুয়া ঝর্ণা থেকে কাছে একমাত্র জুম ঘর তখন পর্যন্ত। আমরা সবাই সেটাই উঠে পড়লাম। জুম ঘরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট হলো এর ভীত পাহাড়ের হলেও ঘরটি থাকে পাহাড় থেকে কিছুটা বাহিরে।
জুম ঘরবাসী আদী মুরং
জুম ঘর ভর্তি পাহাড়ী ফলমূল

প্রায় ঘন্টা তিনেক ট্রাকিংয়ের পর, চারটা গ্রাম অতিক্রম করে সর্বশেষ যে পাহাড়টায় উঠলাম সেটার খাড়া নীচে নেমে গেলেই "দামতুয়া" ঝর্ণা! 
দূর্গম পথ
মাথার ভিতর অনেক প্রশ্ন খেলা শুরু করে দিলো তার মধ্যে প্রধান যেটা ছিলো সেটা হলো- নেমে তো যাবো যেমনে তেমনে, কিন্তু উঠবো কিভাবে? ভেবেছিলাম আমার অবস্থায় খারাপ- ওপাশ থেকে আরেকটি টিম উঠে আসছিলো যার একজন সদস্যকে কাপড় দিয়ে বেধে আরেকজন নিয়ে আসছিলো। সাহস বাড়লো ওকে দেখে।তাদেরই একজন বললো- নেমে পড়েন, সব ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। বিসমিল্লাহ বলে নামা শুরু করলাম বাশ গাছ ধরে ক্রলিং করতে করতে। যখন নামলাম তখন আমাদের চোখ ছানা ভরা!বিশাল ঝর্ণা আমাদের অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্যই যেন তার রুপ সৌন্দর্য উজার করে দিয়ে ঠাই দাঁড়িয়েছিলো! শুধু বিলীন হওয়া বাকী ছিলো আমাদের তাও সম্পূর্ণ করতে কার্পণ্য করলাম না আমাদের মধ্যে কেউই। 
ঝর্ণা পাগল
ভ্রমণ পাগল
ঝর্ণার পাগল সাঈফুদ্দীন ভাই তো ধেই ধেই করে ঝর্ণার পিঠে চড়ে বসলো। যদিও বিপদ থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছিলেন। অফুরন্ত আনন্দ আর তৃপ্তি নিয়ে যখন আমরা ফিরবো তখনই ঘটলো বিপত্তি!রাস্তা একটাই আর সেটা পিছলা আর স্যাতস্যেতে হয়ে গিয়েছিলো, গ্রীব পাচ্ছিলাম না। নিধু দা যতোই বলে আসেন আসেন আমি ততো স্লীপ খাচ্ছিলাম। নিধু দাকে বললাম দাদা আপনার হাতের বাশটার এক পাশ আমাকে দেন আর আপনি উপরে চড়ে আমাকে পুল করেন আমি উঠে আসতে পারবো।সাক্সেস হলাম। কয়েক কদম দেওয়া বাকী শুরু হলো অঝরে বৃষ্টি। সব এক্সপেরিয়েন্স যেন প্রকৃতি এই ট্যুরেই দিয়ে ছাড়বে। উচু পাহাড়ের উপর থান্ডারিং হচ্ছিলো আর বৃষ্টি ঝরছিল। ভয়ংকর সুন্দর যা লিখে শেষ হওয়ার না। দামতুয়া থেকে প্রথম চারজন উঠে হাটা দিলেও আমি আর সাঈফুদ্দীন ভাই ট্যুরটাকে একটু এক্সট্রা ফ্লেভার দেওয়ার জন্য স্লো ট্রাকিং শুরু করলাম উদ্দেশ্য দামতুয়ার পাশ ঘেষে চলে যাওয়া ছোট জল প্রপাতে নামা যার জন্য আমাদের একটু দেরী হয়ে গিয়েছিলো আদুপাড়ায় পৌছুতে যা বাকী চারজন আজ অব্দি জানে না। 
দাম তুয়া জলপ্রপাত

আমি আকাশে পাতিয়া কান শুনেছি শুনেছি তোমারি গান
ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাটতে হাটতে উঠে এলাম আদুপাড়ায় তখন ঘড়ির কাটা পাচটা অতিক্রম করে নিয়েছে।মনে প্রতিজ্ঞা নিচ্ছিলাম এ যাত্রা শেষ, আর নয় বান্দরবান। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব! বাইক আসলো, নিধু দা কে বিদায় দিয়ে চলে এলাম এক কিলো আর্মী ক্যাম্পে।সেখান থেকে আলীকদম হয়ে চকরিয়ার আসলাম রাতের শেষ জীপটায় চড়ে।




 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছেরাপুঞ্জী-মৌসিনরাম ও গোয়াইন-সারি নদী বেষ্টিত সিলেটের অদ্যপ্রান্ত

পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে