অসমাপ্ত


আহমাদ যুবায়ের  

অজিৎয়ের জীবনে দুটোই সম্বল এক কবিতা আর দুই দিপান্নীতা। কবিতার প্রতি তার আগ্রহ ছিলো তখন থেকেই যখন সে প্রথম তারুণ্যে পদার্পণ করেছিলো। জীবনের প্রথম কবিতাটি সে তার বিল্ডিংয়ের নীচ তলায় থাকা রশ্মীকাকে নিয়ে লিখেছিলো। কোন দিন তাকে শোনানো হয়নি অবশ্য। রশ্মীকা ছিলো তাদের জমিদারের মেয়ে। নেহায়েত জমিদারের মেয়ে বলেই হইতো সেই সাহস দেখায়নি সে।  অজিৎ যখন ২৫ বছর বয়সের যুবক তখন সত্যিকার অর্থ প্রেমে পড়া যাকে বুঝায় সেটাতেই পড়েছিলো সে। দিপান্নীতা দিপু। একাউন্টিংয় ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী সে। অজিৎ ইলেকট্রনিকস এন্ড কমিউনিকেশনের ছাত্র। সেও তখন ফাইনাল ইয়ারের।  পরিচয় বলতে সেরকম কিছুই না। ক্যাম্পাসে একদিন মারামারা লেগেছিলো দুপক্ষের। সবাই হুরমুর করে দৌড়াদৌড়ি করছিলো। তখন বিকেল প্রায়, সবাই বাসার দিকে রাওয়ানা হবে এমন সময় দিপান্নীতা মেয়েটি হঠাৎ কোথা থেকে এসে অজিৎতের পাসের সীটে বসে পরে। প্রচন্ড রকমের হাপাচ্ছিলো সে। অজিৎ তার পানির ফ্লাস্কটি এগিয়ে দেয় মেয়েটির দিকে৷ পুরো যাত্রা পথে আর কোন কথাই হয়নি তার সাথে কেবল ফিরতি ধন্যবাদ ছাড়া।  এরপর ক্যাম্পাস প্রায় এক সপ্তাহ বন্ধ ছিলো। অজিৎত তখন প্রায় ভুলেই গিয়েছিলো মেয়েটার কথা। ভার্সিটি খোলার পর আবার মেয়েটির সাথে দেখা হয়ে যায় অজিৎয়ের টংয়ের দোকানের সামনে। এবার অজিৎ সাহস করে যায় দিপান্নীতার কাছে। টুকটাক আলাপ করার চেষ্টা করে। তখনই দিপান্নীতার নাম জানতে পারে অজিৎ।  

আজ এক বছর পূর্তি দিপান্নীতার সাথে অজিৎয়ের সম্পর্কের। তাদের আলাপ চারিতার সম্পর্ক কখন যে ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে সেটা তারা নিজেরাও জানে না। কেউ কাউকে প্রোপজ করেনি ঠিকই কিন্তু একজন অন্যজনকে যথেষ্ট কেয়ার করে চলে। অজিৎয়ের কবিতার প্রতি ফ্যাসিনেশন আছে সেটা দিপান্নীতা জানতো। কিন্তু দিপান্নীতাকে নিয়ে লেখা একটি কবিতাও অজিৎ দিপান্নীতার সাথে সেয়ার করেনি কখনো। 

আগামীকাল দিপান্নীতার জন্মদিন। অজিৎয়ের ঘুম হারাম হওয়ার মতো হয়ে গিয়েছে। দিপান্নীতার জন্মদিনে কি দেওয়া যায় এনিয়েই সে খুব উত্তেজিত। অজিৎ কাগজ কলম নিয়ে লিখতে বসে যায়। দুই লাইন লিখে আবার কাগজ ছিড়ে ফেলে। সে বুঝতে পারে উত্তেজনায় তার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।  

কাজল চোখের অবশ মায়ায়,  

রাত্রি নামে আমার চোখে,  

ঐ চোখেতে পদ্মপুকুর, দিবো কবে ডুব?  

কালো কেশের শ্যামা মেয়ে,  

বাঁকা চাদের মুখ,  

ঐ মুখেতে হাতটি রেখে,  

ছূয়ে দেবো সুখ।  

বিনি কেটে যাবে চুলে,  

তুলোর মতো হাত,  

ভালোবাসার ক্ষণিক টানে,  

দিবো শত উল্লাস।  

মোবাইলে কল আসে দিপান্নীতার।  হ্যালো, বলো।  

দিপুঃ কাল দেখা করতে পারো আমার সাথে? দরকারী কথা আছে।  

অজিৎঃ না বুঝার ভান ধরে, কাল তো ভার্সিটি বন্ধ। কাল কেনো! আর কোথায় দেখা করবে?  

দিপুঃ ক্যাম্পাসের পাশের রেস্তোরাটাই বসা যায়।  

অজিৎঃ আচ্ছা বাবা, সে না হয় বসা যাবে। কিন্তু কেনো?  

দিপুঃ আরে, আগে আসোই না। এরপর বলি।  

অজিৎঃ আচ্ছা ঠিক আছে। খাওয়া দাওয়া হলো রাতের?  

দিপুঃ না, একটুপর করবো। আচ্ছা রাখি এখন। বাসা ভর্তি অতিথি আমাদের। কাল দেখা হচ্ছে বলেই ফোন রেখে দিলো দিপান্নীতা।

মুখোমুখি বসে আছে অজিৎ আর দিপান্নীতা। দিওয়ান্নীতাকে আজ অসাধারণ সুন্দর লাগছে। অজিৎ মনে মনে পণ করে এসেছে, দিপান্নীতাকে আজ যে করেই হোউক সে প্রোপজ করবেই।  

কি ব্যাপার ওভাবে চেয়ে কি দেখছো, হ্যা? দিপান্নীতা নীরবতা ভাঙ্গে।  

অজিৎঃ না, আজ তোমাকে অন্য রকম লাগছে তাই একটু অবাক হচ্ছি।  

দিপান্নীতাঃ আচ্ছা, ওসব বাদ দাও। তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে।  

অজিৎঃ আমারও কিছু কথা ছিলো তোমাকে বলার মতো। আগে তুমি বলে ফেলো।  

দিপান্নীতাঃ তাই নাকি, কি কথা শুনি?  

অজিৎঃ আগে তুমি শুরু করো, এরপর বলছি আমার কথা।  

দিপান্নীতাঃ আচ্ছা, শোন তাহলে। আমার না বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। ছেলেসহ পুরো ফ্যামিলি আমেরিকাতে সেটেল্ড। আর আমাদের ফ্যামিলির সকলেই আমেরিকাতে ধীরে ধীরে সেটেল হয়ে যাওয়ার চিন্তা করছে। তাই বাবাও এই প্রোপজাল ফেরাতা চাচ্ছে না।  

হ্যালো... কি হলো? অজিৎ!  

অজিৎয়ের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো একেরপর এক সাতটি! কি বলছে এসব দিপু!  

দিপান্নীতা বলতে শুরু করে আবার...  আমেরিকাতে ছোট কাকা,কাকীমামা, ছোট মামা,মামীমা সবাই সেটেল্ড। উনাদের ওখানে বিয়ের সব ব্যবস্থা হচ্ছে। তোমাকে যে কিভাবে বুঝাবো, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দেশে, অপরিচিত কিছু মানুষের ভীরে কিভাবে কি করবো কিছুই বুঝছি না।  

অজিৎয়ের মুখ দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে বেড়িয়ে আসে, না গেলে হয় না?  

দিপান্নীতাঃ মানে কি?  

অজিৎঃ হুম? না কিছু না। কবে বিয়ে? কিছু ফাইনাল হয়েছে কি? কবে যাচ্ছো?  

দিপান্নীতাঃ সামনের মাসে বিয়ের লগ্ন আছে, বাবা চিন্তা করছে এমাসেই আমেরিকা চলে যাওয়ার।  অজিৎঃ ওহ! আচ্ছা। অভিনন্দন!!!  

দিপান্নীতাঃ আচ্ছা, এবার তোমার কথা বলো। কি বলতে চেয়েছিলে?  

অজিৎঃ ওহ, ভাবছি গ্রামের বাড়ি যাবো, অনেক বছর হলো শহরের যান্ত্রীকতায়। একটু নির্মল হাওয়া দরকার। শরীরকে, মনকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার দরকার।  

দিপান্নীতাঃ ওহ! এই তোমার জরুরি কথা! আমি আরো ভাবলাম কি না কি বলবে!  কথায় কথায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসে। বাহিরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। দিপান্নীতাকে একটা সিএনজিতে তুলে দিলো অজিৎ।  আজ আলিঙ্গনের দিন। অজিৎ আর এই সন্ধ্যের বৃষ্টি আষ্টেপৃষ্টে আলিঙ্গন করবে অজিৎ।  পকেট থেকে মানিব্যাগটি বের করে চিরকুটটি বের করে অজিৎ। শেষবারের মতো একবার চোখ বুলিয়ে নেয় কবিতার প্রত্যেকটি পংক্তিতে...  

অজিৎ চিরকুট হাতে নেমে পড়ে পিচঢালা রাস্তায়...

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছেরাপুঞ্জী-মৌসিনরাম ও গোয়াইন-সারি নদী বেষ্টিত সিলেটের অদ্যপ্রান্ত

পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে