স্বাধীন
আহমাদ যুবায়ের
একঃ
মানিক, ও মানিক, কৈ গেলি বাপ! জৈষ্ঠ্য মাসের প্রখর রোদ রহিমা বেগমের ঝুপড়ির ছেড়া প্লাস্টিকের ছাদ দিয়ে সরাসরি মুখে এসে পড়েছে রহিমা বেগমের গালে। রেললাইনের পাশে এই বস্তিতে রহিমার বেগমের ছোট সংসার। রোদ,বৃষ্টি, ঝড় যাই যাক, এখানেই তার ছোট সংসার। রহিমা বেগমের একটাই ছেলে।নাম স্বাধীন। রহিমা বেগমের স্বামী রিক্সা চালক ছিলো। মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় অকালেই প্রাণটা চলে যায় যার। ছেলের নামটা সেই দিয়ে গিয়েছিলো বড় আশা করে। রহিমা বেগম বাসা-বাড়ীতে ছুটা কাজ করে তার ছোট সংসার চালায়। আজ তিন দিন হলো গায়ে জ্বরের কারণে বিছানা ধরা সে। ছেলেকে একটা সরকারী স্কুলে বহু কষ্ট করে ভর্তি করিয়েছে, এক বাসার বড় কর্তাকে অনেক বলে কয়ে।
মানিক ঝুপড়ির ভিতরে ঢুকে, হাতে একটা পাউরুটির প্যাকেট আর কিছু ঔষুধ।
বাপ, তুই স্কুলে যাস নাই? রহিমা বেগম কাশতে কাশতে বলে।
আম্মা, টিফিন ছুটিতে আইছি, তোমারে খাওন দিয়া আবার যামু। রহিমা বেগম কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চায় ছেলেকে।
আম্মা, মসজিদের ইমাম সাব কিছু টাকা দিছিলো, সেটা দিয়ে আনলাম এইগুলান। তুমি খাইয়া নাও। স্বাধীন বুঝ দেওয়ার মিথ্যা চেষ্টা করে। দুই টুকরো রুটি আর ঔষুধ দিয়ে স্বাধীন বের হয়ে যায় ঝুপড়ি থেকে। স্কুলের ব্যাগটা রিক্সার সিটের নীচে রেখে সীটটা ভালো করে বসিয়ে দেয় সে।
আজ তিন দিন হলো স্বাধীন স্কুল ফাঁকি দিয়ে মহাজন থেকে বাবার রিক্সা নিয়ে বের হয়। এভাবেই চলে মা-ছেলের লুকুচুরি প্রতিনিয়ত।
পড়ন্ত বিকেল। স্বাধীনের রিক্সা তখন সিটি কলেজের সামনে। স্বাধীন কলেজের গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের আনাগোনা দেখে হৃদয়ে স্বপ্ন বুনতে থাকে স্বাধীন। একদিন সেও অনেক বড় কোন কলেজে পড়বে, পাস করে চাকরী করে সাহেব হবে। মাকে আর বাসা-বাড়িতে কাজ করতে দিবে না স্বাধীন।
এই রিক্সা যাবে... এই রিক্সা!
স্বাধীনের চিন্তায় বাধা পড়ে। কৈ যাবেন? স্বাধীন শুধায়।
এতো অল্প বয়েসে রিক্সা চালাও কেনো তুমি? স্বাধীনের প্যাসেঞ্জার জিজ্ঞেস করে স্বাধীনকে।
স্বাধীনঃ স্যার, আম্মায় অসুস্থ, কয়েক দিন ধরে জ্বর। বাসায় খাওনের কিচ্ছু নাই। আম্মার ঔষুধ কিনোনের টাকা নাই। কি করুম কন।
প্যাসেঞ্জারঃ পড়া লেখা করো না? স্কুলে যাও?
স্বাধীনঃ হ স্যার, ক্লাস নাইনে পড়ি। বিজ্ঞান বিভাগে স্যার। তয় আজ তিন দিন হইতেছে স্কুল ফাঁকি দিতেছি স্যার।
এই পাশে রাখো, দোকানটার পাশে। প্যাসেঞ্জার রিক্সা থামায়। এই নাও ভাড়া বলে ২০টাকার ভাড়াই ১০০ টাকা স্বাধীনের হাতে তুলে দেয়।
স্যার ভাংতি নাই?
প্যাসেঞ্জারঃ না লাগবে না, তুমি তোমার আম্মার হাতে দিয়ো বাকীটা। আর আমার নাম্বারটা রাখো, আমার নাম সাকিব। তোমাকে দিয়ে আমার কাজ আছে। পরে কথা বলবো কেমন।
স্বাধীনঃ আচ্ছা স্যার।
দুইঃ
সাকিব আজ দুই দিন ধরে স্বাধীনকে খুঁজছে আন্তঃজেলা বিজ্ঞান মেলা প্রতিযোগিতার ফেস্টুন নিয়ে, কিন্তু তার কলেজের আসে পাশে তাকে আর দেখাই যাচ্ছে না।
সাকিব আশেপাশের সরকারি স্কুল গুলোতে খোঁজ নিবে বলে ঠিক করলো। বিপত্তি হলো স্বাধীনের ব্যাপারে সে তেমন কোন তথ্যই জানে না।
সাকিব শুরুই করলো তাদের কলেজের পাশের রেলওয়ে স্কুল দিয়ে।
সাকিবের কপাল ভালো নাকি স্বাধীনে সেটা বলা মুশকিল কিন্তু স্কুলের ছোট মাঠেই স্বাধীনকে দেখতে পেলো সাকিব। ক্রিকেট খেলছিলো।
সাকিবকে দেখে চিনতে ভুল হলো না স্বাধীনের। দৌড়ে চলে এলো খেলা বাদ দিয়ে।
স্বাধীনঃঃ স্যার আপনি এখানে?
সাকিবঃ কিরে আমাকে মনে আছে তোর? আর স্যার কিরে! বল ভাইয়া।
স্বাধীনঃ আইচ্ছা, ভাইয়্যা। তয় আপনি এখানে কোন কাজ আইছেন?
সাকিবঃ হুম, কাজ তো অবশ্যই আছে।কিন্তু ভাবতেছি তোকে কিভাবে বুঝায়।
স্বাধীনঃঃ স্যার, তুক্কু ভাইয়্যা। কন ভাইয়্যা আপনি, আমি বুঝুম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন