পূরণ হলো মেঘনা নদীতে নৌ ভ্রমণ
আহমেদ যুবায়ের
৫ই অগাস্ট ২০২০ইং। অফিস কলিগ পরাগ ভাইয়ের সাথে প্রথম ফিল্ড ওয়ার্কের তারিখ পড়লো। স্থান নারায়ণগঞ্জ মেঘনাঘাট ও এর আশপাশ ৫ কিলোমিটার পেড়িফেরা। নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের কিছু অঞ্চল এর অন্তর্গত।মেঘনা নদীর তীরে জেগে উঠা একটি চরে গড়ে উঠেছে কয়েকটি পাওয়ার প্ল্যান্ট। ঢাকা থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে ডেমরা-স্টাফ কোয়ার্টার-মদনপুর হয়ে মেঘনাঘাট আসা লাগে। ঢাকা থেকে সরাসরি মেঘনাঘাট অব্দি লোকাল গাড়ি না থাকলেও মদনপুর কিংবা সোনারগাঁ পর্যন্ত আছে। এখান থেকে বাস কিংবা সিএঞ্জি নিয়ে মেঘনাঘাটে আসা যায়। ঢাকার যান্ত্রিক কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে একটু শান্তির পরশ নিতে সহজেই এখানে আসা যায়। যদিও স্থানটি কোন পিকনিক স্পট না তারপরও যারা আশেপাশে থাকেন তাদের জন্য মেঘনা নদীতে নৌ ভ্রমণ এখান থেকে খুব একটা খারপ হবে না।প্রথমবার অবশ্য এই সুযোগটা হয়ে উঠেনি।
আমাদের গাড়ি মেঘনাঘাট হয়ে মূল প্ল্যান্টে ঢুকলে এখানের কাজ গুছিয়ে নিয়ে পরাগ ভাই নিয়ে গেলেন মোগরাপাড়া বাজার হয়ে মোগরাপাড়া ব্রিজ ফেলে তাহেরপুর পাঁচানীবাজার। এই জায়গাটা সোনারগাঁ উপজেলার নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি গ্রাম। শহরের আভা এখনো এখানে প্রবেশ করেনি বললেই চলে।
পাঁচানি বাজার, তাহেরপুর, মেঘনা নদী
পাঁচানি বাজার থেকে যাত্রা করলাম আমাদের পরবর্তী লোকেশন চর বালাকী। এটি পাঁচানি বাজার থেকে আরো সামনে হোসেন পুর গ্রামের শেষ প্রান্তে। এখান থেকে নৌকা নিয়ে যাওয়া লাগে চর বালাকীতে। আমরা যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছিলো। জোয়ারে পানি তখন হোসেনপুর গ্রামে ছুঁই ছুঁই করছে।
হোসেনপুর গ্রামের শেষ সীমানা, এখান থেকে নৌকা করে চর বালাকী যেতে হয়
সময়টা বর্ষাকাল হওয়ায় চর বালাকী তখন পানীর নীচে ঢুবে ছিলো নিরূপায় হয়ে সেখানে যাওয়া হলো না।
হোসেনপুর গ্রাম,নারায়ণগঞ্জ
আমাদের কাজ শেষ করতে করতে তখন সন্ধ্যা সাতটা প্রায়। সব কিছু গুছিয়ে ছুটলাম ঢাকার পানে। পরের দিন যাওয়ার প্লেন মুন্সিগঞ্জের লোকেশন গুলোয়। এখানে দেখার মতো শুধু গজারিয়া গ্রামটাই সুন্দর মোটামুটি।
এবারের মতো আর মেঘনা নদীতে নৌকো নিয়ে নামা হলো না ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সময় স্বল্পতার জন্য ছেড়ে দিলাম অন্য কোন স্ময়ের জন্য।
প্রায় তিন মাস পর ১৪ই নভেম্বর ২০২০ সালে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টি এসে গেলো।ফিল্ডওয়ার্কে সহকর্মীর সাথে গেলাম নারায়ণগঞ্জ মেঘনাঘাটে। এবার নদীতেও কাজ আছে তাই নৌকা নিয়ে নামাই লাগবে।সকাল সকাল চলে আসলাম দুজন সেই মেঘনাঘাটে।
সকাল থেকে দু একজন জেলে ও কিছু সৌখিন মানুষ ঘাটে বসে ছিপ দিয়ে মাছ ধরছে দেখে উৎসুক হলাম। আমাদের মনিটরিং মেশিন যথাস্থানে বসিয়ে পাশেই একজন জেলের সাথে গল্প শুরু করে দিলাম। তিনি সকাল সাতটা থেকে একটা একটা করে ছোট ছোট পুটি মাছ ধরছেন আর সংগ্রহ করছেন থলেতে। আগ্রহ নিয়ে আমিও চেষ্টা করলাম মন্দ না।
ছিপ দিয়ে মাছ তোলায় ব্যস্ত দুজন
এইঘাটে অবশ্য বিভিন্ন কোম্পানির নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য আলাদা করে জেটি বানিয়ে নিয়েছে জলজযানে উঠানামার সুবিধার জন্য।
মেঘনাঘাট জেটি (অরিয়ন গ্রুপ)
নদীতে নেমে একটু সামনে গেলে দেখা মিলবে প্রকৃত অর্থে জেলে ও জেলে নৌকার। ছোট ছোট মাছ ধরার জন্য জেলেরা অবৈধ কারেন্ট জালই ব্যবহার করে।
কারেন্ট জালের জট খুলতে ব্যস্ত এক জেলে
দেখা মিলবে মাঝিমাল্লাদের আপন মনে বেয়ে চলা নৌকোর সারি। কোনটায় মাছে ভর্তি আবার কোনটা রয়েছে যাত্রা পথে।
নৌকোয় মাছ নিয়ে ফিরছে নীড়ে
চলছে মাঝি জীবিকা অন্বেষণে
এসব অতিক্রম করা আরো সামনে গেলে দেখা মিলবে ছোট ছোট কিছু জাহাজ নোঙর ফেলছে মাঝ নদীতে। হয়তো বয়ে এনেছে কোন রাসায়নিক দ্রব্য কিংবা যন্ত্রপাতি। এই সব জাহাজের আসে পাশের পানি তেলে চিকচিক করে তারউপর সূর্যের আলো পড়ায় চিকচিকে ভাব আর প্রগাঢ়। এসব জাহাজ দূষিত করছে নদ নদীর পানি পরিবেশের কোন তোয়াক্কা না করেই। মনটা খারাপ হয়ে যায় এসব দেখে।
নোঙর গেড়েছে মেঘনার বুকে
শীতকালে নদীর উথালপাতাল অবস্থা একটু কমই মনে হয় বর্ষার সময় এই নদীর পানি বেড়ে ফুলে ফেপে উঠে ডুবিয়ে দেয় এর আশপাশ গ্রাম।
মেঘনার ছোট ছোট মাছ শীতের এই সময়ে বিক্রি করে কেজি ৮০টাকা দরে যা শহর অঞ্চলে কল্পনাতীত।
ছোট মাছ
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীকে ঘিরে বেড়ে উঠা এই সব মানুষের মূল পেশাটা যেন এখনো মাছ চাষ ও মাছ ধরা কেন্দ্রিকই। নদীতে ঘেরা দিয়ে চাষ করে নানা রকমের নানা মাছ।
জেলে জীবন
মুন্সিগঞ্জের সেই গজারিয়া গ্রামে গিয়ে দেখলাম ভিন্ন রূপ। কৃষকের আমন ধান ঘরে তোলার দৃশ্য। কৃষক মনের সুখে এক আপন মনে ধান কেটে চলেছে। জিজ্ঞেস করলাম কি ধান? বললো- আমন ধান, এরপর বোরো মৌসুম।
আমন ধান তুলছেন কৃষক
উন্মুক্ত ধান ক্ষেতে বিচরণ করছে শালিক, সাদা বক আরো নানা রকমের পাখি। চোখ জুড়ানো এক দৃশ্য। দেখতেই ভালো লেগে যায়।
শালিক পাখি
মুন্সিগঞ্জের অন্য আরেকটি বৈশিষ্ট হলো এই এলাকার মানুষদের টিনের ঘর। বন্যা প্রবণ গ্রাম বলে এখানকার ঘর গুলো এমন ভাবে তৈরী করা যেন বন্যার সময় অন্য স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়। এক কথায় স্থানান্ত্র যোগ্য ঘর। ঘরের টিন গুলো ভূমির সাথে খুটিতে বেধে রাখা হয় জেনো ঝড়ো হাওইয়ায় উড়ে না যায়। আর মূল খ্র ফ্লোরের সাথে শিকল দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়ে যেন সরে না যায়।
স্থানান্তর যোগ্য টিনের ঘর, মুন্সিগঞ্জ
সব মিলিয়ে মেঘনা নদী পাড় ঘিরে এই অঞ্চল ও অঞ্চলের জনজীবন আপনার মন কেড়ে নিতে বাধ্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন