দীপ্তর আকাশ




এক.
এখনো কিসের ঘুম! ভার্সিটি যাওয়ার সময় হলো নাকি। বাবার চেঁচামেচিতে সকাল সকাল ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো দীপ্তর। রুবাইয়াত সাহেবের ছোট সংসার। এক ছেলে এক মেয়ে ও স্ত্রী রুবানা। তৃপ্তি তাদের একটি মাত্র আদরের মেয়ে সবে মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ফিলসফি নিয়ে পড়ছে। একই ভার্সিটির ফিন্যান্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র দীপ্ত। রুবাইয়াত সাহেব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনের চাকুরীজীবি আর উনার স্ত্রী রুবানা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক।

রুবাইয়াত সাহেব সকাল সকাল নাস্তা সেরে বেড়িয়ে পড়লেন অফিসের উদ্দেশ্যে।  নাস্তার টেবিলে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে দীপ্তের দিকে ৫০টাকা আর তৃপ্তির দিকে একশ টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলেন রুবানা হক। 

দীপ্ত কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিলো একশ টাকার নোটার দিকে আর যেই বললো- মা...

অমনি রুবানা হক ব্যাগের চেইন বন্ধ করে বললেন তুই ছেলে, দরজটা লক করে দিয়ে যাস ভালো করে বলেই হরহর করে স্কুলের উদ্দেশ্যে রাওয়ানা হয়ে গেলেন। তৃপ্তি পিটপিট করে ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে পাউরুটিতে একটা কামড় বসালো যেনো সে কিছুই জানে না। 

তৃপ্তিঃ ভাইয়া, আমাকে আমার ফ্যাকাল্টি অব্দি নামিয়ে দিস কিন্তু!

দীপ্তঃ কেনো, তোর ঠ্যাং নেই? 

তৃপ্তিঃ দেখ, ভালো হবে না কিন্তু, আমি কিন্তু আব্বুকে সব বলে দিবো তুই ক্যাম্পাসে সিগারেট খাস আর কি কি করিস সব।

দীপ্তঃ ওরে পাজি! তুই আমার খোঁজ নিতে যাস নাকি পড়তে যাস? যা নিলাম না তোকে, যা কি করবি কর।

তৃপ্তিঃ চুপ।

হাত ধুয়ে দীপ্ত তাওয়ালে হাত মুছে বেরিয়ে আসছিলো রুম থেকে, বের হতে হতে দীপ্ত ডাক দিলো তৃপ্তী তালাটা নিয়ে বের হ তাড়াতাড়ি দেরী হয়ে যাচ্ছে! 

তৃপ্তি একলাফে ব্যাগ আর তালা চাবি নিয়ে বেড়িয়ে এলো। 

এই রিকশা যাবে, ষোল শহর রেল স্টেশন! 

তৃপ্তী সন্ধ্যে বেলা বাসায় এসেই দেখে ছোটখালা টিভি রুমে বসে রিমোট নাড়াচাড়া করছেন, পাশে আম্মু বসে শিমের বিচি পরিষ্কার করছে। ছোটখালা থেকে সব সময় একটু দূরে দূরে থাকতে চায় তৃপ্তী। অন্যকোন কারণ না, শুধু দেখলেই বলে চুলটা ঠিক করে কাট, চুল আছড়া, জামাটা একটু সুন্দর করে বানা, সব সময় মাথায় কাপড় দিয়ে চলিস কেনো ইত্যাদি ইত্যাদি চলতেই থাকে। ছোটখালু বিশাল বড় ব্যবসায়ী, চার চারটা বেসরকারী প্রতিষ্টানের মালিক তিনি। টাকা পয়সার কোন অভাব নেই মাশাআল্লাহ। তবে এই নিয়ে ছোটখালার কোন অহঙ্কার করতে দেখা যায় না শুধু ভাগ্নাভাগ্নি গুলোকে একটু শাসনের উপর রাখতে চায় আরকি। 

ছোটখালাঃ কিরে তৃপ্তী, ভার্সিটি থেকে আসতে এতো দেরী কেনো? তুই কি সায়েন্স নিয়ে পড়ছিস নাকি? ক্লাস তো দুপুরেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। (বলা বাহুল্য ছোট খালাও একই ভার্সিটির ছাত্রী ছিলেন যার কারণে খুটিনাটি সবই জানেন)

তৃপ্তীঃ না, খালামনি, আপনি কখন আসলেন, কিছুই তো জানালেন না আসার আগে!

ছোটখালাঃ আমি আসার আগে কি এপয়েন্টম্যান্ট নিয়ে আসা লাগবে? তুই কথা ঘুরাচ্ছিস কেনো? এতো দেরী করলি কেনো? দীপ্তটা কোথায়?

তৃপ্তীঃ ভাইয়া তো টিউশনি করিয়ে আসতে আসতে রাত আটটা নটা বাজবে খালামণি।

ছোটখালাঃ বাকীটার উত্তর কখন দিবি?

তৃপ্তীঃ না খালা মানে বন্ধু বান্ধবদের সাথে একটু গল্প করতে করতে দেরী হয়ে গেলো আজকে। সবার সাথে পরিচয় হলো তো তাই।

ছোটখালাঃ হুম, সাবধানে চলিস, উল্টোপাল্টা বন্ধু যতো পারিস কম বানানোই ভালো। দীপ্ত আসলে আমাকে ফোন দিতে বলবি ঠি আছে?

তৃপ্তীঃ ওমা তুমি কি এখনই চলে যাবে নাকি? রাতে খেয়ে যাও। 

ছোটখালাঃ না, আমার প্রোগ্রাম আছে রাতে, এখন উঠবো। উঠতে উঠতে আপু তোমাকে যা বললাম একটু মাথায় রেখো' 

রুবানাঃ আচ্ছা, সাবধানে যাস। আর সময় করে তোর ছেলে মেয়েদের নিয়ে একদিন ঘুরে যাস সময় নিয়ে। এই বলে রুবানা রান্না ঘরের দিকে পাপ বাড়ালেন।

তৃপ্তী এসব সাংকেতিক কথাবার্তার কিছুই বুঝলো না, শুধু মনে মনে খুশি হলো যাক অল্পের ভিতর শেষ হলো ছোটখালার চ্যাপ্টার আজকের মতো। 

কিরে তৃপ্তী তোর নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! সকাল বেলা নাস্তার টেবিলে বলে বসলো দীপ্ত। দীপ্তর মা দীপ্তর দিকে চোখ কটমট করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। দীপ্ত বুঝতে পারলো বিষয়টা আপাতত গোপনই রাখতে চেয়েছিলো সবাই তৃপ্তীর কাছ থেকে, কিন্তু দীপ্ত সব শেষ করে দিলো। 

তৃপ্তীঃ ছোটখালা তোকে ফোন দিতে বলেছেন, আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে ক্লাসের আমি যায় বলেই দরজার দিকে হাটা দিল। 

দীপ্তঃ আরে কোথায় যাচ্ছিস আমিও যাবো তো, দাঁড়া, পিছু নিলো আদর আর কুন্সুটির একমাত্র ছোট বোনের। 

দুই.

আমার এ-গান

কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে—

আজ রাত্রে আমার আহ্বান

ভেসে যাবে পথের বাতাসে,

তবুও হৃদয়ে গান আসে।

ডাকিবার ভাষা

তবুও ভুলি না আমি—

তবু ভালোবাসা

জেগে থাকে প্রাণে;

পৃথিবীর কানে

নক্ষত্রের কানে

তবু গাই গান;

কোনোদিন শুনিবে না তুমি তাহা, জানি আমি—

আজ রাত্রে আমার আহ্বান

ভেসে যাবে পথের বাতাসে—

তবুও হৃদয়ে গান আসে...।

আপনার ফাইনাল এক্সাম কবে? শ্রাবণকে থামিয়ে দেয় তৃপ্তী।

শ্রাবণ সামনে এসে দাঁড়ায় তৃপ্তীর, চোখে ভাষা বুঝার চেষ্টা করে।

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে— এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয়— হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে,

হয়তো ভোরের কাক হ'য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়;

হয়তো বা হাঁস হবো— কিশোরীর— ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,

সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে;

আবার আসিব আমি বাংলায় নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে..

আপনি কি কোন দিনই সিরিয়াস হবেন না? এবার একটু রেগেই বলে ফেললো তৃপ্তী।

শ্রাবণঃ বিয়ে কবে?

তৃপ্তীঃ চুপ।

শ্রাবণঃ তোমার হাতটা একটু দিবে, নির্জনতায় হারাতে ইচ্ছে হচ্ছে।

তৃপ্তী চেয়ে দেখে আর অবাক হয় মানুষটা হাসিখুশি থাকে ততক্ষণ যতক্ষণ সে আপন জগতে ঘুরে বেড়ায়। যান্ত্রিক জীবন থেকে যতোটা পারে দূরে থাকতে পারলেই সে খুশি থাকে ভিতর থেকে।

শ্রাবণ ফাইনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, তৃপ্তীও জানে তার আরো দুই দেড় বছর চলে যাবে পড়ালেখার পাঠ চুকাতে চুকাতে। তার পর আছে চাকরীর প্রিপারেশন। কিন্তু কি করবে সে, অজানা আতংক ভর করেছে তৃপ্তীর বুকে।কলেজে থাকা অবস্থায় এক বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচয় হয় শ্রাবনের সাথে তৃপ্তীর টিউশনের ব্যাপারে। শ্রাবণ ব্যাচ পড়াতো অর্থনীতি , পৌরনীতির।

তৃপ্তীর হুশ ফিরে দীপ্তর ফোনে।

কিরে কই তুই? আমি মূল গেটে তাড়াতাড়ি আয়, একসাথে বাসায় ফিরবো।

শ্রাবণ থেকে বিদায় নেয় তৃপ্তী।

বাসায় এসেই দেখে বাবা খবরের কাগজের দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে কি যেন পড়ছে, পাশে ছোট খালা কটমট করে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের দিকে চোখ পড়তেই ইশারায় ভিতরে যেতে বললো তৃপ্তীকে।

দীপ্ত, এসেছিস ভালো হয়েছে, এখন কাপড় চোপড় ছাড়া লাগবে না, আমাকে গাড়ি অব্দি দিয়ে আয়, আমি উঠি বলেই ছোট খালা ব্যাগটা নিয়েই হরহর করে দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। দীপ্ত বুঝতে পারলো বাবার সাথে কিছু একটা হয়েছে ছোটখালার। দীপ্ত পিছু নিলো ছোট খালার। 

দীপ্ত, তোর বাবার মাথা নষ্ট হয়েছে, এতো ভালো একটা পাত্রকে না করে দিয়েছে! বলে মেয়ে সবে ফার্স্ট ইয়ারে। পড়া লেখা শেষ করুক এরপর না হয় দেখা যাবে। মেয়েদের নাকি শিক্ষায় একমাত্র সম্বল। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে হয় মেয়ের বাবাকে। তোর বাবাকে বুঝা, এখনো দেরী হয়নি। 

দীপ্ত মনে মনে খুশি হতে থাকে, আসলেই বাবা সঠিক জায়গায়ই কথা বলেছেন। কি বা বয়স হয়েছে তৃপ্তীর বিয়ে দিয়ে দেওয়া লাগবে! 

দীপ্তঃ আচ্ছা খালা, আমি বাবা বুঝাবো। তুমি মাথা ঠান্ডা করে বাসায় যাও। আল্লাহ হাফেয।

দীপ্ত হাসি মুখে রাস্তার ওপর পাশের আইস্ক্রীম পার্লারের দিকে হাটা দেয়। 

এই ভাই, আইস্ক্রীম দেন তো চারটে, চকবার আইস্ক্রীম। 

দীপ্ত হাসি মুখে মোবাইল ফোনটা ধরে, কিরে তৃপ্তী! আসছি আমি একটুপর।

তৃপ্তীঃ ভাইয়া, তাড়াতাড়ি বাসায় আই, বাবার প্রেসার বেড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।

দীপ্ত দোকানেই আইস্ক্রীম রেখে বাসার দিকে ছূটতে থাকে, মাথায় অসংখ্য দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে।

দীপ্তর মা এরই মধ্যে এম্বুলেন্স ডেকে ফেলেছেন, এম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে রুবাইয়াত সাহেবকে। পেছনে রুবানা হক একমাত্র সুখ দুঃখের সাথী। 

দীপ্ত যখন বাসার আঙ্গিনায় তখন এম্বুলেন্স রাওয়ানা হচ্ছে। 

ভাইয়া, আম্মু আব্বুকে নিয়ে হস্পিটালে রাওয়ানা দিয়েছে, আমি তোর জন্য বসে আছি। দীপ্তর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ভাইয়া, এই ভাইয়া... তৃপ্তীর ডাকে বাস্তবে ফিরে দীপ্ত। সিনজি ডাক একটা। 

দীপ্তঃ ও! হ্যা। 

আউট অফ ডেঞ্জার, মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছিলো, উত্তেজিত করবেন না উনাকে, কমপ্লিট রেস্টে রাখতে হবে আগামি একমাস। রুবানা হকের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার গড়্গড় করে কথা গুলো বলে চলে গেলেন। 

তৃপ্তীঃ মা, বাবার কি অবস্থা মা? হাসপাতালের ১২১ নং বেডে ঢুকেই তৃপ্তী হাপাতে হাপাতে মাকে জিজ্ঞাসা করে। 

রুবানা হক উত্তর করে না, দীপ্তর দিকে এগিয়ে যায়, দীপ্তর হাত ধরে বাহিরে নিয়ে এসে বলে, আগামী তিন মাস তোর ছোটখালা যেন তোর বাবার ত্রিসীমানায় না আসে। কিভাবে সম্ভব আমি জানি না। এটা তোর দায়িত্ব।

দীপ্ত হতচকিয়ে যায় মায়ের মুখের কথা গুলো শোনার পর। 

দীপ্ত মনে ভাবে আত্মীয় স্বজন অসুস্থ হলে আশা যাওয়া বাড়িয়ে দেয়, কেউ যদি চলেই আসে তাকে কিভাবে আটকানো যাবে, মা এসব কি বলে। তার ছাড়া হয়তো ছোট খালাকেই দায়ী করছেন মা, বাবার অসুস্থতার জন্য, সেখানে ছোটখালা তো অবশ্যই আসবে! মোবাইলের রিং টোনে ভাবনার জগতে ব্যাঘাত ঘটে দীপ্তর। স্ক্রীনে লেখা উঠেছে Penpen Khala। দীপ্ত ফোন ধরে না। সাইলেন্ট মুডে রেখে দেয়। 

তিন.

আজ প্রায় পনেরো দিন দীপ্তর বাবা ঘরে বসা। এরকম জীবনে কখনোই ছিলেন না, সারা জীবনই কাজের ব্যস্ততায় চলে গিয়েছে রুবাইয়াত সাহেবের। এভাবে শুয়ে বসে খেতে খেতে তার রীতিমতো দিনদিন পরাধীন পরাধীন লাগা শুরু করেছে। 

রুবানা হকঃ তুমি এতো সাত সকালে এতো ফিটফাট হয়ে বসে আছো যে? 

রুবাইয়াত সাহেবঃ সকালের নাস্তাটা কি করে দেওয়া যাবে? আমি অফিস যাবো। 

রুবানা হকঃ মানে কি এসবের? তোমাকে ডাক্তার সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলছে, তুমি কোথাও যাচ্ছো না। 

রুবাইয়াত সাহেবঃ আমার দম বন্ধ লাগছে এভাবে বসে থাকতে থাকতে, তুমি নাস্তা দিবে নাকি আমি এভাবে চলে যাবো?

রুবানা হক চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পরিচিত মানুষটার দিকে। সে জানে মানুষটা তার কথা শুনবে না, বেশি চাপচাপি করলে ভিতরে ভিতরে ফুসবে ঠিকই কিন্তু কিছু বলবে না।

রুবানা হকঃ বসো আমি আসছি, নাস্তা নিয়ে। 

দীপ্ত, এই দীপ্ত উঠ, দীপ্তর রুমের দরজায় রুবানা হক টোকা দেয়। 

দীপ্তঃ মা, কি হয়েছে? 

মাঃ শোন, ভার্সিটীতে দেরী করে যাস আজকে, আগে তোর বাবার পিছু পিছু যা, ঠিক ঠাক মতো অফিস যেতে পারছে কিনা খেয়াল রাখিস।

দীপ্ত বুঝে, বাবার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গেছে, তাই আর পাল্টা প্রশ্ন না করে উত্তর দেয় দীপ্ত, আচ্ছা মা, আমি যাচ্ছি। 

এই রিক্সা, দীপ্ত যেই রিক্সায় উঠবে অমনি হুট করে কোত্থেকে টিপটপ সাজুগুজু করা একটা মেয়ে রিক্সায় উঠে পড়লে, উঠেই বলে চলেন মামা! 

আফা, আমি যামু না, আমি এই মামারে নিমু, দীপ্তকে দেখিয়ে দেয় রিক্সাওয়ালা। 

আরে দীপ্ত না? আসো আমার সাথে চলো, দীপ্ত কিছু বুঝতে পারে না, চেনাচেনা লাগছে কিন্তু সাজুগুজুর কারণে বুঝতে পারছে না মেয়েটাকে। 

ওমন করে তাকিয়ে আছো কেনো? কোথায় আসো, উঠে বসো।

দীপ্ত কোন কিছু না বুঝেই রিক্সায় উঠে বসে, রিক্সা চলতে থাকে। দীপ্ত চুপ করে শুধু মনে করে চেষ্টা করতে থাকে মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে সে। 

রিক্সা এসে থামলো ওমেন্স কলেজের সামনে। আচ্ছা যায় বলেই দীপ্ত কে বিদায় দিয়ে চলে গেলে মেয়েটা। ভাড়াটাও দিয়ে গেলো না।

মামা, কোথায় যাবেন? 

দীপ্তঃ যেখান থেকে এনেছেন সেখানে দিয়ে আসেন মামা।

কিরে, তোর আব্বু ঠিকঠাক পৌছেছে তো? দীপ্ত মায়ের দিকে কিছুক্ষণ  তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে যায়। রুবানা হক জানে তাঁর ছেলে মিথ্যা বলতে পারে না। সে খুন করে আসলেও মিথ্যা বলবে না যে, সে খুন করেনি। 

দীপ্তর মাথায় এখন দুটী চিন্তা ঘুরছে। এক আজীজ আংকেল আর রিক্সার মেয়েটার কথা। আজীজ আংকেলই বাবার অফিসে বাবার খুব কাছের এক শুভচিন্তক। 

হ্যালো, আসলামু আলাইকুম। আংকেল, আমি দীপ্ত, কেমন আছেন আংকেল? দীপ্ত ব্যাগ গুছাতে গুছাতে ফোন দেয়।

আজীজ আংকেলঃ হ্যা, বাবা কেমন আছো তোমরা? আর তোমার বাবাকে ছেড়ে দিলে কেনো এতো তাড়াতাড়ি?

দীপ্তঃ আংকেল, একটু দেখে রাখবেন দয়া করে, বাবাকে তো চিনেনই যখন যেটা মনে আসে সেটাই করে ছাড়ে।

আজীজ আংকেলঃ তোমার বাবাকে দেখে রাখার সাধ্যি কার বলো? তুমিও নাকি তোমার বাবার মতোই হয়েছো! হা হা হা! 

দীপ্ত আজীজ আংকেলের বিধ্বংসী হাসির শব্দে ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। আচ্ছা আংকেল ভালো থাকবেন আমি ভার্সিটির দিকে যাবো। আসসালামু আলাইকুম বলে ফোন কেটে দিয়ে রুম থেকে বের হবে দেখে মা দাড়িয়ে আছে চৌকাটে। 

দীপ্তর দিকে ১০০ টাকা বাড়িয়ে দেয় দীপ্তর মা। দীপ্ত ভ্রু কুঁচকে টাকাটার দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে নেয়। 

যাওয়ার সময় তৃপ্তীকে নামিয়ে দিয়ে যাস ওর ফ্যাকাল্টিতে। দীপ্ত বুঝে নেয় বাকী পঞ্চাশ তারই রিক্সাভাড়া। 

চার.

কিরে ভাইয়া তুই নাকি আজকে লাবণ্যকে ওদের কলেজে ড্রপ করতে গিয়েছিলি? তৃপ্তী দীপ্তর রুমে ঢুকেই সন্দেহের চোখে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

দীপ্তঃ মানে? কি যাতা বলছিস! আমি আবার কখন কাকে ড্রপ করতে গেলাম! সকালেই না তোর সাথে ভার্সিটি গেলাম। 

তৃপ্তীঃ ওহ আচ্ছা, তাহলে যাসনি, তাহলে ঠিক আছে। পরে যেন কাউকে ডাকা না হয়!

দীপ্তঃ সে বুঝলাম, কিন্তু লাবণ্যটা কে?

তৃপ্তীঃ তুই জেনে কি করবি! তুই তো যাসনি। বাদ দে! বাদ দে!!

দীপ্তঃ যা তো যা এখান থেকে, বেশি পাকনা হচ্ছিস দিনকে দিন। 

তৃপ্তী ভেংচী দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। দীপ্ত মনে মনে চিন্তা করে আচ্ছা মেয়েটার নাম তাহলে লাবণ্য! বাহ বেশ সুন্দর নাম তো! কিন্তু কে সে? তৃপ্তী বান্ধবী? 

দীপ্ত এই দীপ্ত, যা তো, তোর ছোট মামার বাসায় বিরানী গুলো দিয়ে আয়। আজ বাসায় ভালো রান্না বান্না হয়েছে। আব্বু অসুস্থ হওয়ার পর প্রথম অফিসে গেলো। সবাই খুশি। আব্বু একটু বেশি। 

দীপ্তদের দু ঘরের পড়েই ওর ছোট মামার বাসা। দরজার বাহিরে কলিং বেল চাপ দিল দীপ্ত। 

কাকে চায়? ভিতর থেকে একটি সুরেলা আওয়াজ আসলো।

দীপ্তঃ আমি, দীপ্ত, আম্মু পাঠিয়েছে। 

দরজা খুলতেই দীপ্ত হা হয়ে গেলো, এতো সকালের মেয়েটাই! ও এখানে কি করছে! 

আরে দীপ্ত ভাই আসেন ভিতরে আসেন।

কি আশ্চর্য সকালেই না দীপ্ত দীপ্ত করছিলো, এখন সরাসরি ভাই!

কেরে মা? ছোট মামা আসলেন দরজার সামনে। কিরে দীপ্ত আয়, ভিতরে আয়।

দীপ্তঃ না মানে মামা, আম্মু এসব পাঠালেন তাই দিতে এলাম। এখন আসি আসসালামু আলাইকুম- বলেই দীপ্ত মামার হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসলো।

লাবণ্য দীপ্তর হতচকিয়ে যাওয়া বেশ উপভোগ করছিলো, কিন্তু বুঝতে দিচ্ছিলো না। 

তৃপ্তী, এই তৃপ্তী কোথায় গেলি রুমে আই তাড়াতাড়ি... দীপ্তর মাথার ভিতর সব উল্টোপাল্টো হয়ে যাচ্ছে!

তৃপ্তীঃ কিরে কি হলো! বাড়ী মাথায় নিলি কেনো হঠাৎ?

দীপ্তঃ কিছু না, এক গ্লাস পানি খাওয়া, আর যাওয়ার সময় রুমের লাইটটা অফ করে দিয়ে যাস।

দীপ্ত মনে মনে ভাবে সমস্যা তো তার নিজের। সে ভুলেই গিয়েছিলো ছোটমামার একটা মেয়ে আছে। কিন্তু সে এতো বড় কখন হয়ে গেলো সেটাই বুঝতে পারছে না দীপ্ত। অবশ্য দীপ্ত আর কিছুদিন পর ভার্সিটী থেকে বের হয়ে যাবে। ওর ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। ক্যাম্পাসে যায় শুধুমাত্র স্যারের প্রজেক্টের কাজে। সময় খুব তাড়াতাড়ি বয়ে চলছে দীপ্ত অনুধাবন করে। 

রাত প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে, দীপ্তর ঘুম ভেঙ্গে গেলো চিৎকার শুনে। প্রথমে ভাবলো হয়তো স্বপ্ন দেখছিলো, পড়ে বুঝলো তাঁর নাম ধরেই ডাকছে কেউ। দীপ্ত ছুটে বের হয় রুম থেকে। তৃপ্তীও বের হয়েছে দেখলো দীপ্ত। রুবাইয়াৎ সাহেবের রুমের থেকে আসছে চিৎকারটা। দীপ্তর মা ডাকছে স্বজোরে। 

বাবার রুমে ঢুকেই দীপ্তর শক্ত হয়ে গেলো, মা বসে আছে বাবার পাশে, বাবা নিথর শুয়ে আছে বিছানায়। দীপ্তর মাথায় যেন একটু আগেও একটা শক্ত ছাদ ছিলো যেটা এক মুহুর্তে উড়ে চলে গেলো! 

বাবার পাশে বসে পড়লো দীপ্ত, ধাতস্থ হাতে পালস চেক করার চেষ্টা করলো, কোন পালস নেই। দীপ্ত ছুটে বের হয় এই রাতে ফিরোজা আন্টিদের বাসায়, পেশায় যদি গাইনি ডাক্তার কিন্তু এই রাতে এখন তিনি ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

আন্টি বাবার কি হয়েছে, বাবা কথা বলছে না কেনো আন্টি? ফিরোজা আন্টির দিকে করুনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তৃপ্তী। 

ধৈর্য্য রাখো মেয়ে, আল্লাহর কাছে সব কিছুর সুষ্ঠ পরিকল্পনা থাকে। আমাদের শুধু ধৌর্য্য ধরে রাখতে হয়। এই বলে আন্টি দীপ্তকে মসজিদে খবর দিতে বলে উঠে গেলেন। 

শেষ.

মি. ইসলাম... মি. ইসলাম... হ্যায় মি. ইসলাম! 

দীপ্ত হতচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখে মিস হ্যালেন তাকেই ডাকছেন। দীপ্তর পুরো নাম আরিফুল ইসলাম দীপ্ত। 

উন্ট ইয়ু গো হোম? ইট'স সিক্স পিএম, মিস. হ্যালেন আবার শুধায়।

আজ সাত বছরে পা দিলো দীপ্তর বাবার মৃত্যু বার্ষিকীর। আর মায়ের পাঁচ বছর চার মাস! রুবানা হক দীপ্তর বাবাকে এতো বেশি ভালোবাসতেন সেটা তাঁর সন্তানরা টের পেলো যখন বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেলো। রুবায়েত হকের এভাবে চলে যাওয়া তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। দিন দিন স্বাস্থ্যহানী হতে থাকে রুবানা হকের। স্কুলে যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন শেষের দিকে। তৃপ্তী শুধু পরীক্ষাটাই দিতে যেতো ক্যাম্পাসে। বাকী মায়ের সাথেই থাকতো বেশির ভাগ সময়। দীপ্ত একটি বেসরকারী চাকরী শুরু করেছিলো মাঝে পরে সুইডেনে ফুলফান্ডেড স্কলারশিপটা পেয়ে যায়। যেদিন দীপ্তর মেইল আসে ঠিক তাঁর আগের দিন রুবানা হক স্ট্রোক করে মারা যান। 

দীপ্ত তৃপ্তীকে নিয়ে চলে আসে সুইডেন আর তার কলেজেই অনার্সে এডমিশন নিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।  পিএইচডি শেষ করার পর কলেজ কর্তৃপক্ষ দীপ্তকে লেকচারের পদ অফার করে। 

আজ এতো বছর পর দীপ্তর স্মৃত্তিচারণে একে একে সব ভেসে আসছে পরিচিত সবার ছবি। বাবা, মা, লাবণ্য! 

লাবণ্য আজ তাঁর এক মাত্র পুত্র সন্তান স্বাধীনের মা। একদিন রাতে লাবণ্য সরাসরি সুইডেনে ফোন দেয় দীপ্তর কাছে। বলে বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। হয় তুমি ফোন দিবে বলবে আমাকে তুমি চাও না হয় আমি ছাদে যাবো এক্ষুণি। এরপরের ঘটনার জন্য আমাকে দায়ী করবে না। 

দীপ্ত তখন ল্যাবে কঠিন ইকুয়েশন সবাধানে ব্যস্ত কিন্তু বুঝলো জীবনের ইকুয়েশন আরো জটিল। ছোট মামা দীপ্তকে না করতে পারেনি। 

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে, দীপ্ত একা হাটতে হাটতে একটা কঠিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৃপ্তীর কথা ভেবে। তৃপ্তীকে দীপ্ত বলেছে শ্রাবণ ছেলেটা বিয়ে করে ফেলেছে ওর গ্রামেরই এক মেয়েকে। কিছু ছবিও দেখায়! 

দীপ্ত জানে দীপ্ত কাজটা ঠিক করেনি। আবাসিক হল থেকে শ্রাবণের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়েছিলো। দীপ্ত জানতো তৃপ্তী শ্রাবণকে খুব পছন্দ করতো, একই ক্যাম্পাসে থাকায় শ্রাবণের ব্যাপারে সব খবরই রাখতো দীপ্ত। কিন্তু কখনোই তৃপ্তীকে এসব বুঝতে দিতো না। সে তার মাকে শেষ হয়ে যেতে দেখেছে বাবার শোকে তিলেতিলে। তৃপ্তীই তখন তার একমাত্র পরিবার। তৃপ্তী পর্যন্ত শ্রাবণের কোন খবরই পৌছুতে দেয়নি দীপ্ত। 

দীপ্ত ডোরবেল চাপে। লাবণ্য দরজা খুলতেই পিছন থেকে মামা বাবা বলে দৌড়ে আসে আনিকা আর স্বাধীন। আনিকাটা স্বাধীনের এক মাসের বড়। আনিকা তৃপ্তির মেয়ে। 

দীপ্ত কোন মতে ফ্রেশ হয়ে সোফায় গিয়ে বসে মাথাটা পিছন দিকে এলে দেয়। দীপ্তর ডান বাহুর নীচে স্বাধীন আর বাম বাহুর নীচে আনিকা। 

দীপ্ত মন খারাপের পৃথিবীতে খুঁজতে থাকে তার বাবা আর মাকে। দীপ্ত দেখে ছোট্ট দীপ্ত দৌড়ে যাচ্ছে তার বাবা আর মায়ের দিকে...।। 

---সমাপ্তি---

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছেরাপুঞ্জী-মৌসিনরাম ও গোয়াইন-সারি নদী বেষ্টিত সিলেটের অদ্যপ্রান্ত

পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে