আব্বা!

আহমেদ যুবায়ের

 

একটু আগে অনুভব করলাম বাবা(আব্বা)কে নিয়ে স্মৃতি গুলো আস্তে আস্তে মুছে যেতে শুরু করে দিয়েছে। তাই ভাবলাম কিছু লিখে রাখার চেষ্টা করি। চাইলে কাগজের ডায়েরীতেই লিখতে পারতাম, এক সময়ের টুকিটাকি ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা একেবারেই ছাড়া হয়ে উঠেনি। সময় হলেই লিখে রাখি টুকটাক কিন্তু কোথাইয় যে কখন কোন ডায়েরি রেখে আসি পরে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।তাই ভাবলাম এখানেই লিখে রাখি। মাঝে মাঝে পড়া যাবে, চোখ অশ্রুতে সিক্ত করা যাবে আর কখনো কখনো একটু আধটু মুচকি হাসা। 

ছোট বেলা থেকেই বড় হয়েছি বাসার সবার আদর পেয়ে পেয়ে, শুধু মেঝভাইয়ের মাইর খাওয়া ছাড়া। আম্মা আব্বার কঠোর আদেশ ছিলো আমাকে যেন কেউ না মারে, কারণ আমি কান্নাকাটি করলে ঘরে একটা না একটা অঘটন ঘটতো। আব্বা আম্মার দাবি এটাকে (আমাকে) আল্লাহর থেকে চেয়ে আনা, সুতরাং সাবধান!

আমাদের নালাপাড়ার বাসাটায় একটা মিটসেফ ছিলো আর এই মিটসেফেই আমার ছোট বেলার সকল রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। মিটসেফের ড্রয়ারে একবার দুটো রাবারের পাইপ পেয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম এগুলো কিসের। আব্বা আম্মা বলেছিলো ছোটবেলায় তোমার ব্রংকাইটিস নিউমোনিয়া হয়েছিলো, বুকের ভিতর কফ জমে বসে গিয়েছিলো। আব্বার কথা মতে এই পাইপ গুলো দিয়ে আম্মা নিজের মুখ দিয়ে আমার বুক থেকে কফ টেনেটেনে বের করেছিলো। ডাক্তাররা নাকি যখন শেষ কথা জানিয়ে দিয়েছিলো তখন আব্বা দোয়া করে কান্নাকাটি করে আল্লাহ্‌র কাছে থেকে চেয়ে পেয়ে নিয়েছিলো আমাকে। 

তখন কেবল প্রথম শ্রেণীতে সম্ভবত, বাংলা অক্ষর ''ঋ'' লিখতে অনেক কষ্ট হতো। আব্বা অনেক করে "ঋ'' লেখাতে চেয়েও ব্যর্থ। আব্বাকে খুশি করতে কার্বন পেপার দিয়ে এঁকে দিয়ে ধরাও খেয়েছিলাম। 

আব্বা যখন আসতো কলেজ থেকে আমরা ভাই বোন যে যেখানে থাকতাম দৌড়ে বই নিয়ে এসে এক সাথে গলা ফাটিয়ে পড়তে বসতাম, আমরা ভাবতাম আব্বা কিছুই বুঝবে না। কিন্তু জানতাম না বাসায় আব্বার প্রতিনিধি আম্মা তো ছিলোই। আসলে আম্মা কি কিছু বলে দিতো কিনা তা আজো জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি।

ঝাপ্সা ঝাপ্সা মনে পড়ে বিটিভির রাত আটটার বাংলা সংবাদ আর রাত দশটার ইংরেজি সংবাদ চলা সময়ে চুপচাপ থাকতাম আমরা সবাই আব্বার বকা থেকে বাঁচতে।

ক্লাস এইট পর্যন্ত আমার ধরাবাঁধা ছিলো ৩/৪ বিষয়ে ডাব্বা মারা, মজার ব্যাপার হলো এই নিয়ে আব্বা কোন দিনই রাগ করে নাই অন্যদিকে বড় ভাই রেজাল্ট খারাপ করলে তুমুল ভাবে চলতো টর্নেডো! একবার মনে পড়ে বড় ভাইয়ের বই খাতা উঠানে ছুড়ে ফেলেছিলেন পড়া লেখা করতে হবে না বলে।

মনে আছে চট্টগ্রাম বোর্ড আর কুমিল্লা বোর্ড তখন একছিলো, আব্বা কুমিল্লা বোর্ড থেকে এইচএসসির খাতা আনতো। খুব রাত করে বাসায় আসতো কুমিল্লা থেকে আর আমরা বসে থাকতাম কুমিল্লার মিষ্টি খাওয়ার জন্য।

আব্বার কলেজের শিক্ষা সফরেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো একবার, তবে কয়েকটা মিউজিয়ামের ঝাপ্সা ঝাপ্সা স্মৃতি ছাড়া আর কিছু মনে নেই। এমনকি কোথায় নিয়ে গিয়ে ছিলো সেটাও না, তবে নৌকা করা নদী পাড় হওয়া লেগেছিলো একটা জায়গায় এসে!

খুব জ্বর ছিলো বার্ষিক পরীক্ষার সময়। তাও উর্দু পরীক্ষা। সারা রাত জ্বরে তোলপাড়। সকাল বেলা আব্বা ঘুম থেকে তুলে পরীক্ষার হলে দিয়ে আসলেন। বললেন যা পারো লিখতে থাকো। আমি কি লিখবো আর প্রশ্নে কি আসছে সেটা দেখার সময় ছিলো না, নিজের যা পড়া ছিলো তাই লিখে দিয়ে আসছিলাম যেমন উর্দু শব্দার্থ, কবিতা, ব্যাখ্যা ইত্যাদি। সেই যাত্রা ৩৩ পেয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ছিলাম।

আব্বাকে নিয়ে আমার কষ্টকর মুহুর্ত গুলো শুরু হয় ক্লাস সিক্সে থাকা অবস্থায় থেকে। আব্বার ঘাড়ে ফোঁড়ার অপারেশন থেকে।ছোট ছিলাম তাই অতো জ্ঞান বেশি ধারনা ছিলো না, বুঝতাম শুধু এখন আর আনন্দ করা যাবে না, টিভি দেখা যাবে না, খেলাধূলা বন্ধ, বেশি বেশি নামাযে দোয়া করা লাগবে।সেই বারই প্রথম আমাদের হাসপাতালে ঈদ হলো। আব্বা যখন সুস্থ হয়ে ঘরে আসলো ভেবেছিলাম কষ্টের দিন গুলো বোধহয় শেষ হলো, ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে পাড়ায় বের হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক দুইবছরের মাথায় ধরা পড়লো আব্বার মাথায় টিউমার। তখন বিটিভির নাটক গুলোয় দেখে যা বুঝতাম তা থেকে ধরে নিলাম আব্বাকে আর বাঁচানো যাবে না। আমাদের সময় যেন ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে চলা শুরু করলো! চিকিৎসার জন্য মাদ্রাস ভেল্লোর গেলেন, লাভ হলো না কিছুই, অপারেশনের রিস্ক নিলে মারা যতে পারেন তাৎক্ষনিক। আম্মা এই রিস্ক নিলেন না। আমরা বাবার মুখ দেখতে পারবো না সেটা কিভাবে হয়, তার চেয়ে যে কয় বছর বাঁচবে ছেলে মেয়েদের সাথে বাঁচুক। দেশে আসলেন কোন এক জুমাবারের ভোর বেলায়। সকাল সাতটা বাজে তখনাকার টিভি চ্যানেল এনটিভি খুলে দেখতে পেলাম আব্বার কলেজের প্রিন্সিপাল সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছে মর্মান্তিক ভাবে। অফিসের অন্যান্য কলিগরা মিলে ফাঁসিয়ে দিলেন আমার আব্বাসহ আরো দুইজনকে যারা পরবর্তী প্রিন্সিপাল পদপ্রার্থী ছিলেন। আমার অসুস্থ বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। আমাদের মাথায় আকাশের উপরে যতো কিছু আছে সব কিছু সাথে করে নিয়ে যেন পড়লো। 

ঈদ গেলো জেলে, জেল থেকে হাসপাতালে আনা হলো, কুরবানের ঈদ হলো হাস্পাতালে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাস্পাতলের পঞ্চম তলায় আমরা পালা করে খাবার নিয়ে যেতাম। আব্বা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো আমাদের। টুকটাক কথা বলতেন। একবার মনে আছে খুব রোদে খাবার নিয়ে দুপুর বেলা হাস্পাতালে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম ক্লান্ত হয়ে। আব্বা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন আমার কষ্ট দেখে।

দীর্ঘ ছয়মাস পর আদালত আব্বাকেসহ দুই কলিগকে স্ব-সম্মানে বেখসুর খালাস দেয়। আমরা তখন অন্য দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম। আসেপাশের অনেক কাছের মানুষকে তখন চেনা হয়ে গিয়েছিলো। আব্বার সাথে আব্বার খুব আপন জনও যেমন পিঠ দেখিয়েছে তেমনি দূরের অনেকেই ফেরেস্তা হয়ে কাছে এসেছিলো সেই সময়। 

বাসায় আসার পর আব্বা রিটায়ার করলেন চাকরীর তিন চার বছর থাকা সত্ত্বেও। ইচ্ছে করেই দিয়েছিলো হইতো রিটায়ারমেন্ট।

বাসায় আব্বার অবস্থা কয়েক মাস ভালোই ছিলো, আমরা ছোট দুই ভাই বোন সব সময় আব্বার সাথে থাকতাম। মাঝে মাঝে আব্বার পরিচর্জায় অনেক বেশি ত্রুটি হয়ে যেত জানি না এসবের জন্য আল্লাহ্‌ আমাদের ক্ষমা দিবেন কিনা। আব্বাকে ধরে ধরে নিয়ে মসজিদে যেতাম আমি। মনে পড়ে একটা সময় আব্বা আমাকে নিয়ে যেতেন ঠিক সেই ভাবে। 

আব্বা মারা গেলেন অনেক কষ্ট সহ্য করে, আম্মা অনেক বেশি ভালোবাসতেন আব্বাকে। মৃত্যুর পর দিন সকাল বেলা উঠে আব্বাকে স্বাভাবিক ভাবে ''বাপ্পির আব্বা, বাপ্পির আব্বা'' বলে ডেকে ডেকে ঘুম থেকে উঠে হাটা দিয়েছিলেন বাড়িতে। দেখেছি আব্বার বড় ছেলেকে বাড়িতে থেকে ফিরে বাবাহীন বাসায় ঢুকে সবার থেকে আড়াল করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁধতে।

আমাদের ছাদ চলে গেলো আমাদের উপর এক সাগর অভিমান ঢেলে দিয়ে।

"রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানে ছাগীরান''

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ছেরাপুঞ্জী-মৌসিনরাম ও গোয়াইন-সারি নদী বেষ্টিত সিলেটের অদ্যপ্রান্ত

পুরনো ঢাকার অলিতে গলিতে